অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখি একদিকে অনেক স্মৃতির মিছিল। আবার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে অশ্রু ও বেদনায়। প্রিয় শিক্ষকদের ছবিগুলো মানসপটে ভেসে ওঠে। আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব। কার কথা বলবো। বন্ধুবর সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা। অনেকের মতো নিজেকে যখন প্রশ্ন করি, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণে আমাদের সাফল্য ও অর্জন কতটুকু? প্রয়াত শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তেজগাঁও কার্যালয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আলোচনায় সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের প্রস্তাব রেখেছিলাম। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছিল দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের—বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের। সময়ের ব্যবধানে তার অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখলাম, শেরেবাংলার স্মৃতিবিজড়িত সাটুরিয়ায় একাত্তরের বধ্যভূমি ব্যবহূত হচ্ছে, এমন কাজে যা শোভন তো নয়ই—লেখায় প্রকাশযোগ্যও নয়। বিজয়ের অর্থ তো পরাজয়ের অনুপস্থিতি। আজকের দিনটিতে এ নিয়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা বড় প্রয়োজন। অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিপীড়ক শাসক-শোষক গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত বিজয়ের দিনটি ছিল বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরম কাঙ্ক্ষিত পরিণতি। অবরুদ্ধ স্বদেশের সন্ত্রস্ত আবালবৃদ্ধবনিতা, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ব্যাপক বেসামরিক মানুষ, অগণিত অকুতোভয় দুরন্ত তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ইপিআরে কর্মরতদের একটি অংশ এবং পাকবাহিনীর নৃশংস বর্বরতায় দেশত্যাগে বাধ্য, সাময়িক প্রবাসী জীবন যাপনকারী মানুষদের কাছে এ দিনটি ছিল হায়েনার থাবা থেকে মুক্তি, পরিত্রাণ ও স্বস্তির দিন। স্বজন হারানোর বেদনা, দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত বিজয়ের দিন। এর ঠিক দু’দিন আগে উদ্ঘাটিত হয় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, আলবদর আলশামসের নৃশংস বর্বরতা। রায়ের বাজারের বধ্যভূমি, মিরপুরে ভেসে ওঠে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিসেবীদের লাশ। পৈশাচিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের হত্যা করা হয়। জীবিত অবস্থায় তাদের চোখ উপড়ে নেওয়া হয়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরে বায়াত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার নেতৃত্বাধীন সরকার বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কার্যক্রম হাতে নেয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি, পরিবেশ, অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন দেশের উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নীতিমালা প্রণয়ন করে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ, স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, দূরের ও কাছের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়। এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী প্রতিক্রিয়াশীল দেশি-বিদেশি চক্রের মনঃপূত না হওয়ায় তারা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত্রের জাল বিস্তার করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির সঙ্গে গণতন্ত্রবিরোধী সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের গাঁটছড়া, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য আনুকূল্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়া ও পশ্চাদপদতার উল্টোপথে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ধ্যান ধারণা ও কার্যক্রমের লালন ও পুনর্বাসন শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে তিলে তিলে শক্তি সঞ্চয় করে সকল প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলেও অবস্থান শক্ত করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। তারপরও শিক্ষা উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তি প্রসার, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও মোবাইল ফোন গণমুখীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের বিধিমালা তৈরি করে অর্থ প্রদান শুরু হয়। কিন্তু জনকল্যাণে এসব বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ক্ষমতা থেকে আবার সরে যেতে হয়।
এরপর ক্ষমতায় আসীন হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। দুঃশাসন, সীমাহীন দলীয়করণ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ লালনের কারণে, তাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত লাল সবুজের পতাকা তুলে দেয়। একের পর এক নিষ্ঠুর পেশাজীবী দলন ও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার কার্যক্রম নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিত দেশকাঁপানো, বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিক্ষক আন্দোলনের সূচনা হয়। এর প্রেক্ষাপট রচিত হয় নিজেদের রক্তে লেখা স্মারকলিপি দিয়েও শিক্ষক নেতারা সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎ না পাওয়াসহ অসহনীয় নির্যাতন ও বঞ্চনা ভোগের বাস্তবতায়। এ অবস্থায় নির্যাতনের স্টিম রোলার মোকাবিলায় তাদের পাশে এসে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের শিক্ষক আন্দোলনে এ ঘটনার তাৎপর্য অপরিসীম। এর মধ্য দিয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের আন্দোলনে নতুন মেরুকরণ সূচিত হয়। তারা স্পষ্টত রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনার সহমর্মিতায় নির্ভরতার আশ্রয়স্থল খুঁজে পান। এ ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলমত বিভিন্নতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা
মহাজোটের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। তাদের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বলে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি এর একটি বড় কারণ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হলে দলীয় বিবেচনায় যারা মহাজোটের অথবা মহাজোটভুক্ত দলগুলোর সমর্থক নন কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, তারাও নির্বাচনের সময় মহাজোটকে সমর্থনের যৌক্তিকতায় আবার আস্থা খুঁজে পান। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ৩ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দেশের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের পক্ষ থেকে বিশ্বের ছয় কোটি শিক্ষকের কাছে যুদ্ধাপরাধী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচারে নৈতিক সমর্থন দেওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। সেখানে বলা হয় : ‘যারা আমাদের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, হত্যাকাণ্ডে সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছে, যারা পৈশাচিক নির্যাতনের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে, জীবিত অবস্থায় তাদের চোখ উপড়ে নিয়েছে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছে, নারীদের চরম অসম্মান ও অপমান করেছে ও তাতে সহায়তা করেছে, ধর্মের নামে চরম অধর্মকে উসকে দিয়েছে, স্বাধীনতা ও গণবিরোধী সামরিক জান্তাকে প্রকাশ্যে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়েছে, নির্বিচারে শিশু হত্যা করেছে, ন্যূনতম মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছে, তাদের বিচারকাজে আমরা বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষকে নৈতিক সমর্থন প্রদানের জন্য মানবিক আবেদন জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ত্রিশ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের ১১টি সংগঠন নিয়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট সব দেশের সব জাতির শিক্ষক ও সচেতন মানুষের প্রতি একাত্মতা প্রকাশের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।’ এরপর ২০১১ সালের ২০ আগস্ট ফ্রন্টের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে বিশ্বের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নৈতিক সমর্থন চেয়ে পেশকৃত মানবিক আবেদনে বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে কোনো দেশে কোনো সমাজে এ ধরনের পৈশাচিক নরাধম কার্যক্রম কেউ যাতে পরিচালনা করতে না পারে, সমর্থন ও সহযোগিতা দান থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় সে লক্ষ্যে আমাদের এ মানবিক আবেদনে বিশ্বের সংবেদনশীল বিবেকবান মানুষ সাড়া দেবে।’ নিউইয়র্কে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে যারা শিক্ষকতায় নিয়োজিত এবং স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত, তাদের সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে এ আবেদনপত্র পৌঁছে দিতে পারার জন্য আমি যথার্থই গর্ব অনুভব করি।
এবারের বিজয় দিবসের আলোচনায় ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু রায় বাস্তবায়নের মতো অর্জনের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় শিক্ষায় কথা। এদেশে এই প্রথম কোনো শিক্ষানীতি ঘোষণার পর তার বিরুদ্ধে কোনো মিছিল, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়নি। এমনকি সরকার বিরোধী বিএনপির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, দুজন তাত্ত্বিক শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, অনুমোদিত শিক্ষানীতিকে স্বাগত জানান। তারা বলেন, শিক্ষানীতি মোটামুটি যুগোপযোগী ও আধুনিক। তবে এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের ঐকমত্য বিরল ঘটনা। স্বীকার করতে হবে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের পাঁচ বছরে শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। বিগত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে—জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ও দক্ষ জনবল তৈরির জন্য দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ প্রণয়ন, স্কুলে ১ জানুয়ারি ও কলেজে ১ জুলাই ক্লাস শুরু, ১ নভেম্বর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু এবং ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ, প্রাক-প্রাথমিকসহ প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক বিনা মূল্যে বিতরণ, ১৯৯৫ সালে প্রণীত কারিকুলাম যুগোপযোগী করে শতাধিক নতুন বই প্রকাশ, তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে প্রাকৃতিক ও দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঝুঁকিহ্রাস সংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্তকরণ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষার ফরম পূরণ অনলাইনে সম্পন্নকরণ। ২০ হাজার ৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, ৩ হাজার ১৭২টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম বিটিভির মাধ্যমে সম্প্রচার, সারা দেশে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, কারিগরি শিক্ষা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেরা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের মানদণ্ড পুনর্নির্ধারণ ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যে কয়েকটি। তবে এর সঙ্গে অবাস্তবায়িত প্রত্যাশাগুলোর উল্লেখও করতে চাই। প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারের কাছে দেশের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা যেসব প্রত্যাশা পূরণের অপেক্ষায় আছেন, সেগুলো হলো—এক. শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বায়ত্তশাসন। দুই. সুনির্দিষ্ট প্রকাশ্য নীতিমালার ভিত্তিতে ইউনেস্কোর সুপারিশ মোতাবেক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রাথমিক-পরবর্তী স্কুল ও কলেজ জাতীয় দায়িত্বে অধিগ্রহণ বা জাতীয়করণ। তিন. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় শিক্ষক ও অভিভাবকের ক্ষমতায়ন। চার. পরীক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কার : (তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সাময়িক উপশম দিলেও চূড়ান্ত বিচারে তা অকার্যকর হবে এবং পরীক্ষা পদ্ধতিরই পরিবর্তন করতে হবে—এ উপলব্ধির অনুপস্থিতি) পাঁচ. শিক্ষা আইন চূড়ান্তকরণ ও সংসদে অনুমোদন। ছয়. শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ কমিশন ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন। সাত. স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের প্রাপ্য পদোন্নতি। আট. উন্নত, উন্নয়নশীল ও আশপাশের বিভিন্ন দেশের অনুরূপ শিক্ষকদের জন্য বেতনকাঠামো নির্ধারণ ও কর্মচারীদের চাকরিবিধি বাস্তবায়ন। নয়. বিনা বেতন বা পারিশ্রমিকে কাজ করানোর নীতি পরিহার করে এমপিও প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বিবেচিতদের এমপিওভুক্তি। ১০. পূর্ণাঙ্গ পেনসন প্রবর্তনের লক্ষ্যে শিক্ষক কর্মচারী অবসর বোর্ডে সরকারের সহায়ক অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় ৩৫ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীর অব্যাহত অবর্ণনীয় দুর্দশা। ১১. শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে সরকারের সহায়ক আর্থিক অনুদান। ১২. শিক্ষায় কাম্য বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ : গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের প্রস্তাব ও ২০১৪ সালের ৪-৬ আগস্ট, ব্যাংকক শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের জিডিপির ছয় শতাংশ বা বাজেটে মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব কার্যকর। ১৩. দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে শিক্ষার অবস্থান নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ।
অবাস্তবায়িত প্রত্যাশাগুলো তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্জিত সাফল্যগুলোও চিহ্নিত করা দরকার। জাতীয় উন্নয়ন, মানবসম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৪৫ বছরে যে হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আগে কখনো তা ঘটেনি। মাথাপিছু আয় ৭০ ডলার থেকে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতএখন ২৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। শিশু মৃত্যুহার কমানোর স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে। মানুষের গড় আয়ু চার দশকের ব্যবধানে ৫০ থেকে বেড়ে ৭১ বছর নয় মাসে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে নিছক দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষা ও অর্থনীতির অনভিপ্রেত ক্ষতি এড়ানো গেলে এ অর্জন হতে পারত আরও ঈর্ষণীয়। তারপরও সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়ের জন্ম দেয়। একাত্তরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শুধু অবকাঠামোই ধ্বংস হয়নি, হানাদার বাহিনী এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মেধাশূন্যও করতে চেয়েছিল। সার্বিক অর্থে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না, মহল বিশেষের এ সংশয় অসত্য প্রমাণ করে, জনসংখ্যাধিক্য, দুর্বল অর্থনীতি প্রভৃতিক যুক্তিকে অসার প্রতিপন্ন করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।
আমরা এরই মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এ বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তৈরি পোশাক শিল্পে আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করছি। আমাদের গড়ে উঠেছে মেধাবী মানবসম্পদ, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের অর্থনীতিতে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা এভারেস্টের চূড়া জয় করতে পেরেছি। ক্রিকেটে আমাদের ছেলেরা বিশ্বের অন্য সব শক্তিশালী দেশের সঙ্গে লড়ার শক্তি অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। যদিও বাল্যবিবাহের অভিশাপ মোচনে সরকারের প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপে সঙ্গতি আছে কি না, বলা কঠিন। স্পষ্ট করে বলতে গেলে সামাজিক বাস্তবতার অজুহাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণে সরকারের অবস্থান সমর্থনযোগ্য নয়। তা প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আপস না বাস্তবতার মূল্যায়নে অক্ষমতা, নিকট ভবিষ্যৎই তা বলে দেবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ইতিমধ্যে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ রপ্তানির দেশে পরিণত হবে। তৈরি হবে পরমাণু বিজ্ঞানে দক্ষ জনশক্তি। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ইতিমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের প্রাথমিক সারিতে উন্নীত হয়েছে। আরও আশার কথা, আমাদের সক্ষম জনগোষ্ঠী বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের দিকে দিনের পর দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। সরকারও সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজের প্রতি শিক্ষিত যুবকদের অনীহাও ক্রমেই কমছে। অনেকে কৃষি পেশায়ও আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, চাকরির জন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই। কৃষিজ্ঞান, তত্ত্ব-তথ্য সবই এখন হাতের মুঠোয়। সে জন্য অফুরন্ত সুযোগ ব্যবহার করে দেশে কাজ করা উচিত। অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বিদেশে গিয়ে জীবন হারানোর চেয়ে দেশের ছেলেমেয়ের দেশেও তো কাজ করা যায়।
প্রত্যক্ষ ও মুখোশে উর্দি শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিভিন্ন অরাজক আচরণ, অনাচার ও দুর্নীতির পরও এভাবেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এদেশে কোনো অবস্থায় উগ্রবাদী, মৌলবাদের অবস্থান হতে পারে না। ক্ষুধা, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্যমুক্ত, প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, মেধায় ও মননে, শ্রমে ও ঘামে প্রগতিশীল, উন্নত বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়ে উঠুক এবারের বিজয় দিবস। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যাদের আত্মত্যাগে আজকের বাংলাদেশ, তাদের যথাযথ সম্মান দিতে না পারলেও অন্তত তাদের অমর্যাাদা হয়, এমন কিছু যেন আমাদের দিয়ে না হয়। গৌরবজনক হবে তাদের যেন আমরা না ভুলি। তাদের আদর্শে যেন পথ চলি।
লেখক: প্রবীণ শিক্ষক নেতা
principalqfahmed@yahoo.com