মুক্তিযুদ্ধে পাঁচ স্বজন হারানো পরিবারটি আজও পায়নি স্বীকৃতি

প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। দেশ তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে দেশের একের পর এক এলাকা তখন মুক্ত হতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কোথাও পাকিস্তানিদের হামলায় তখনও প্রাণ হারাচ্ছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। ঝিনাইদহ সদরের গিলবাড়িয়া গ্রামের মোকছেদুর রহমানের বাড়ির কাছেই ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকতে সহায়তা, খাবারের জোগানসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন মোকছেদুর।

৪ ডিসেম্বরের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের দুপুরের খাবার পৌঁছে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে ঘরের বারান্দায় বসেছিলেন তিনি। কথাবার্তার ফাঁকে ভাবছিলেনÑরাতের খাবার কী হবে? এমন সময় হঠাৎ গিলাবাড়িয়ার আকাশে হানা দেয় শত্রæবাহিনীর বিমান। বোমার মুহুর্মুহু আঘাতে কেঁপে ওঠে তার বাড়ি। বোমার আঘাতে প্রাণ হারান মোকছেদুর রহমান, স্ত্রী ছকিনা খাতুন এবং তাদের তিন সন্তান তোতা মিয়া, পাতা মিয়া ও রানু খাতুন।

পাকিস্তানিদের বোমারু বিমানের তাণ্ডব থেকে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন মোকছেদুরের ১০ বছরের ছেলে মিজানুর রহমান ও আট বছরের মেয়ে চায়না খাতুন। মা-বাবাকে হারানোর পর অনেক কষ্ট করে বড় হতে হয়েছে এই দুই ভাইবোনকে। কিন্তু তারা পাননি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি।

মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গিলাবাড়িয়া গ্রামের মোকছেদুর রহমান পেশায় ছিলেন আইনজীবীর সহকারী। ভয়াল সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে মোকছেদুর রহমানের ভাতিজা শামছুর রহমান (৭০) জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান সেদিন তাদের গ্রামের ওপর দিয়ে পাক খাচ্ছিল। ভয়ে সবাই ছোটাছুটি শুরু করেন। চাচা (মোকছেদুর রহমান) ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। হঠাৎ তাদের বাড়ির ওপর বোমা পড়তে শুরু করে। ঘটনাস্থলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা যান মোকছেদুর। একইসঙ্গে প্রাণ হারান তার স্ত্রী ছকিনা খাতুন, মেয়ে রানু খাতুন এবং দুই ছেলে তোতা মিয়া ও পাতা মিয়া। আহত হন ছোট মেয়ে চায়না খাতুন। বাড়ির বাইরে থাকায় বেঁচে যান ছেলে মিজানুর রহমান।

মিজানুর রহমান জানান, ছোটবেলায় স্বজনদের হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। জয়গুন নেছা নামে এক চাচির দেয়া খাবার খেয়ে বেঁচে ছিলেন। রাতে ভয় নিয়েই ঘুমাতে হতো। ভয়ে দু ভাইবোন কান্নাকাটিও করেছেন। তিনি আরও বলেন, একসময় জীবিকার জন্য তিনি দর্জির কাজ শুরু করেন। এই কাজ করেই জীবন চালিয়েছেন। এখন তার চার ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে শাহীনুর আলম একটি ফার্মেসিতে কাজ করেন।

মিজানুরের বড় ছেলে শাহীনুর আলম জানান, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পরিবারকে দুই হাজার করে টাকা অনুদান দেন। এই তাদের শেষ প্রাপ্তি। কিন্তু তারা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি চান। এজন্য বিভিন্ন দপ্তরে ছুটেছেন। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় উচ্চ আদালতে রিট করেছেন, যা বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান লিংকন জানান, পরিবারটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আদালতে চেয়ে আবেদন করেছে। শুনানি শেষে রায় তাদের পক্ষেই আসবে বলে আশা করা যায়।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার সিদ্দিক আহমেদ বলেন, স্বাধীনতায় পরিবারটির অবদান ছিল। স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. বদরুদ্দোজা শুভ জানান, নতুনভাবে তালিকাভুক্ত করার কোনো চিঠিপত্র আসেনি। এ ধরনের কিছু এলে অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে, যা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০