মুক্ত গণমাধ্যম বিরোধীদের তৎপরতায় ২০৫ নাগরিকের উদ্বেগ

শেয়ার বিজ ডেস্ক: মুক্ত গণমাধ্যম বিরোধীদের তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ২০৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। 

আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই উদ্বেগের কথা জানান।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, গণমাধ্যমের ওপর মার্কিন ভিসানীতির প্রয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বক্তব্যের সূত্র ধরে একটি মহল বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই মহলটি ইতিপূর্বে দেশের স্বাধীন গণমাধ্যম প্রথম আলো নিষিদ্ধ করার জন্য এবং বিতর্কিত আইনে দায়েরকৃত মামলায় পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রতিবেদকে গ্রেফতারের অন্যায় দাবি জানিয়েছে। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদকের অপসারণ দাবি করেছে। বিভিন্ন সময় ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী মতের গণমাধ্যম বন্ধ করার দাবি তুলেছে এবং গণমাধ্যম বন্ধে সরকারের পদক্ষেপে সমর্থন দিয়ে এসেছে। এই গোষ্ঠীটি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন কর্তৃত্ববাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নমূলক পদক্ষেপে বরাবরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন যুগিয়েছে।

আমরা মনে করি, রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে তাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য-বিবৃতি প্রকারান্তরে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে রক্ষারই আয়োজন এবং এই তৎপরতা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে অন্তরায়।

তারা বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ দু’দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ছলে-বলে-কৌশলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। বল প্রয়োগ করে সভা-সমাবেশে সংগঠিত অধিকার এবং সকল উপায়ে মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিহত করে চলেছে। গুলি, লাঠিচার্জ, আক্রমণ, আঘাত, গুম, খুন, গ্রেপ্তার, গণগ্রেপ্তার, মামলা, গায়েবি মামলার মাধ্যমে পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।

সরকারের একরোখা মনোভাবের কারণে দুটি প্রতারণামূলক নির্বাচনের পর আরো একটি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের কোনো সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ও লজ্জাজনক হলেও এই পরিস্থিতিতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড কমিয়ে আনতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভিসানীতি প্রণয়নের পর সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের পরিসর বিস্ময়করভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।

বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির সমর্থনে টিকে থাকা এই সরকারের দমনমূলক নীতি প্রশমিত করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নীতি ও পদক্ষেপগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের চলমান আন্দোলনে বিশ্বের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ, দেশ ও সংগঠনের সমর্থন খুবই প্রত্যাশিত ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা মনে করি।

দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সকল দলের জন্য প্রয়োজনীয় সমান সুযোগের পরিবেশ তৈরি হয়নি দাবি করে এতে বলা হয়, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই শুধু সেই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশসসহ নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িত সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এমন একটি নিরপেক্ষ সরকারই নিতে পারে।

তারা আরো বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যমেও সমান সুযোগের পরিবেশ তৈরি করা দরকার। দুঃখজনক হলেও সত্যি, গণমাধ্যমে সকলের জন্য সমান সুযোগ নেই।

 সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উদ্বেগজনকভাবে সংকুচিত হয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোর প্রতি সরকারের বৈরী নীতির কারণে সেগুলোতে অস্বস্তি ও ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যমকে নিশানা করে বিজ্ঞাপন বন্ধের মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় সেগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী মতের সমর্থক প্রায় সব গণমাধ্যম এই সরকারের আমলে হয় বন্ধ হয়েছে, নয়তো মরণাপন্ন অবস্থায় কোনোরকমে টিকে আছে। নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের মধ্যে জেল-জুলুমের তীব্র ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনেক সাংবাদিক নির্যাতন, নিপীড়ন, মারধর, আক্রমণ এমনকি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছে একপেশে, একচেটিয়া সুবিধাভোগী সরকার-সমর্থক একটি মিডিয়া-ব্যবস্থা। ক্ষমতাসীনদের তোষণ, তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডে অব্যাহত সমর্থন ও গণবিরোধী অবস্থানের কারণে অনেক সংবাদমাধ্যম জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এ অবস্থায়, গণমাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করতে এবং স্বাধীন গণমাধ্যম-বিরোধী অবস্থান থেকে সরকারকে সরিয়ে আনতে জরুরি পদক্ষেপ দরকার।

তারা বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে বন্ধ করে দেওয়া ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী মতের সকল পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও নিউজ পোর্টাল খুলে দিতে হবে। বিদ্যমান সকল গণমাধ্যমে সরকার ও বিরোধীদের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। যে মহলটি গণমাধ্যমের ওপর মার্কিন ভিসানীতিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে সেটিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্তরায় বলে প্রচার করছেন তারা দেশের গণমাধ্যমের চরম বিপর্যয়েও নিশ্চুপ ছিলেন ও আছেন। কেননা এই মহলের অনেকেই সুবিধাভোগী, সরকার-সংশ্লিষ্ট ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অংশীদার। অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাধা সৃষ্টির জন্যই তারা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে চলেছেন বলে আমরা মনে করি।

এ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বাতিল এবং বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক রায়হান রাইন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস চৌধুরী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দীন, শিল্পী অরূপ রাহী, দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া, নারী অধিকারকর্মী দিলশানা পারুল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর রাজী, আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ, শিল্পী মুস্তাফা জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সায়মা আলম, চলচ্চিত্র নির্মাতা মুহাম্মদ কাইউম, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী সায়েমা খাতুন, লেখক মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন, লেখক জিয়া হাসান, লেখক আবু সাঈদ আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক অর্বাক আদিত্য, ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ, লেখক ও অনুবাদক লুনা রুশদী, গবেষক ও অধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট, তুহিন খান, কবি বায়েজিদ বোস্তামিসহ ২০৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০