ইসমাইল আলী: বর্তমানে মুনাফায় রয়েছে দেশের গ্যাস বিতরণকারী প্রতিটি কোম্পানি। গত অর্থবছর বিতরণকারী ছয় কোম্পানি মোট মুনাফা করে প্রায় এক হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এরপরও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে খাতভেদে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বা তারও বেশি হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে তিতাস, বাখরাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পৃথকভাবে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। অন্য কোম্পানিগুলো চলতি সপ্তাহে তাদের প্রস্তাব জমা দেবে।
প্রস্তাবনায় দেখা যায়, গ্রাহক পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ৩৭ পয়সা। তবে তা বাড়িয়ে ২০ টাকা ৩৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার গড়ে ১১৭ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রস্তাব অনুসারে বাসাবাড়ির এক চুলার মাসিক বিল হবে দুই হাজার টাকা, যা বর্তমানে ৯২৫ টাকা। আর দুই চুলার মাসিক বিল হবে দুই হাজার ১০০ টাকা, যা বর্তমানে ৯৭৫ টাকা। এছাড়া আবাসিকে মিটারযুক্ত গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের গ্যাস দাম বর্তমানে ১২ টাকা ৬০ পয়সা। তা বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৩৮ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ছে যথাক্রমে ১১৬ দশমিক ২২, ১১৫ দশমিক ৩৮ ও ১১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এদিকে শিল্প ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম
১৭ টাকা চার পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৭ টাকা দুই পয়সা এবং ক্যাপটিভে (শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাস) ১৩ টাকা ৮৫ পয়সার স্থলে ৩০ টাকা ৯ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার চার টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৭ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইভাবে চা বাগানে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৯৭ পয়সা এবং সিএনজির দাম ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬ টাকা পাঁচ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
যদিও গত অর্থবছর বড় অঙ্কের মুনাফা করেছে প্রতিটি গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি। এর মধ্যে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি ৩৫১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, তিতাস গ্যাস ৩৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি ১৮৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, বাখরাবাদ গ্যাস ১৪৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা মুনাফা করেছে।
এদিকে বিতরণকারী কোম্পানিগুলো মূল্য নির্ধারণের ব্যাখ্যায় দেখিয়েছে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে দেশি-বিদেশি গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স এবং নানা চার্জ মিলিয়ে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে বছরে ৮৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে ৪৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার এলএনজিতে ব্যয় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা, যার মধ্যে ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে মূসক পাঁচ টাকা ৫০ পয়সা, অগ্রিম আয়কর ৭৪ পয়সা, ফাইন্যান্সিং ব্যয় এক টাকা ৪৪ পয়সা, ব্যাংক চার্জ ও কমিশন ৫৯ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় এক টাকা ৮৬ পয়সা, অপারেশনাল ব্যয় পাঁচ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর তিন টাকা ৫২ পয়সা।
দেশে কার্যরত বিদেশি গ্যাস কোম্পানির (আইওসি) গ্যাস কিনতে ব্যয় হবে প্রতি ঘনমিটারে দুই টাকা ৯১ পয়সা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) এবং বাপেক্সের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৮৭ দশমিক ৯৮ পয়সা, ৩৩ দশমিক ৮৩ পয়সা এবং চার টাকা ৫৫ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি ঘনমিটারে পরিচালন মার্জিন সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) ৮৬ দশমিক ৪৮ পয়সা ও বিতরণ কোম্পানির ২৭ দশমিক ৪৯ পয়সা ধরা হয়েছে। আর প্রতি ঘনমিটারে পেট্রোবাংলার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় পয়সা, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৪৬ দশমিক ১৪ পয়সা এবং জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ৮৮ দশমিক ৭০ পয়সা চার্জ ধরা হয়েছে। আর ভ্যাট ধরা হয়েছে ১৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল শেয়ার বিজকে বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাব দিলে তা যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করা হয়। সেখানে যদি দাম বৃদ্ধির বাস্তব কারণ পাওয়া যায় তবে দাম বাড়বে; না হলে তা বাতিল করা হবে। গ্যাসের তিনটি বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব পাওয়া গেছে। তাদের কাছে আরও তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় খাতভেদে গড়ে দাম বাড়ানো হয়েছিল ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ।