দেশের বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের মুনাফায় ভারসাম্যহীনতার যে চিত্র গতকালের শেয়ার বিজের প্রধান প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। এটা শুধু আমানতকারীকে নিরুৎসাহিত করবে না; প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও ভালো মানের বিনিয়োগ গ্রাহক পাওয়াও কঠিন হবে ওসব ব্যাংকের পক্ষে। গ্রাহকরা ব্যাপকভাবে আমানত তুলে নিলে ব্যাংকগুলোকে পড়তে হতে পারে তারল্য সংকটে। এ পরিস্থিতি আবার তাদের বিনিয়োগ গ্রাহকদের জন্য সৃষ্টি করতে পারে নতুন সংকট। এজন্য আমানত ও ঋণের মুনাফার হার এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যা উৎসাহব্যঞ্জক হয় উভয় পক্ষের জন্য। কিন্তু মুনাফার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে কিছু ব্যাংকের যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা শুধু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক নয়, খোদ ব্যাংকিং খাতের জন্যই শঙ্কার।
এটা ঠিক, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় ব্যাংকিং বিজনেস। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটাকে অসুস্থই বলা চলে। এ ধারা থেকে তাদের বেরিয়ে আসা উচিত। এজন্য মনোযোগ দেওয়া উচিত আমানত ও ঋণের মুনাফার ভারসাম্যপূর্ণ হার নির্ধারণে। এটা করা গেলে তা সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগগ্রহীতা উভয়কেই উৎসাহ জোগাবে। বাস্তবতা হলো, এখন ব্যাংকিং খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক আমানতকারী। বাড়তি হারে লাভ পাওয়ার আশায় তারা ঝুঁকছেন সঞ্চয়পত্র ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) দিকে। আমানতের মুনাফা উৎসাহব্যঞ্জক হারে নির্ধারণ হলে তাদের এ খাতে ধরে রাখা সহজ হবে। অন্যদিকে যৌক্তিক হারে মুনাফা নির্ধারণ করা হলে নতুন বিনিয়োগ গ্রাহক পাওয়া সহজ হবে ব্যাংকগুলোর পক্ষে। উদ্বৃত্ত তারল্যের সঠিক ব্যবস্থাপনায়ও এ কৌশল সহায়ক হবে। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালন ব্যয় সমন্বয়ের জন্য অপচয় কমানোর পাশাপাশি মানবসম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে।
আমানত ও ঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ব্যাপারে গত মাসে একটি সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফার হার অত্যধিক হ্রাস সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষুণœ করছে এবং সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পর্যবেক্ষণ যে যথার্থ, তাতে সন্দেহ নেই। সার্কুলারটিতে এমন শঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। বস্তুত এমন পরিস্থিতি অর্থনীতিতে ডেকে আনতে পারে বিশৃঙ্খলা। এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে স্প্রেড সংকোচন, খেলাপি ঋণ হ্রাস, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিতে বলা হয়েছিল সার্কুলারে; আমানতের সুদ বা মুনাফা সংকোচন করে নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনা সঠিক ও সময়োপযোগী।
সত্য হলো, সার্কুলার জারির প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও এর বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। যদি পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তাহলে গতকালের প্রতিবেদনে এ ধরনের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে আসতো বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারটি যে ব্যাংকগুলো যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নেয়নি, সেটা কি সংশ্লিষ্টদের নজরে নেই? নাকি জানা থাকার পরও তারা পালন করছেন নীরবতা? অবশ্য এটা ঠিক, সার্কুলারটির বাস্তবায়ন কবে থেকে করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনার উল্লেখ তাতে নেই। ব্যাংকগুলো সেটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে আমানত ও ঋণের ভারসাম্যপূর্ণ মুনাফার হার নির্ধারণে পদক্ষেপহীন নিয়েছে কি না, আমরা জানি না। এজন্য বাস্তবায়নের তারিখ উল্লেখপূর্বক আরেকটি সার্কুলার জারি করা উচিত। অন্যান্য সার্কুলারের মতো এটির যাতে যথাযথ বাস্তবায়ন হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদারকি আমরা প্রত্যাশা করি।