মুনাফা থেকে টানা লোকসানে উসমানিয়া গ্লাস

পলাশ শরিফ: প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও কাচের মূল্য হ্রাসে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড। সর্বশেষ গত দুই অর্থবছর ধরে লোকসান দিচ্ছে প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো এ কোম্পানিটি। চলতি অর্থবছরেও পিছু ছাড়ছে না লোকসান। অথচ মাত্র তিন বছর আগেও (২০১৪) মুনাফায় ছিল ওসমানিয়া গ্লাস।

তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, ১৯৫৯ সালে বেসরকারি কাচ উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে উসমানিয়া গ্লাস। এরপর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। একমাত্র কোম্পানি হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন লাভজনক অবস্থানে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিন কোটি ৯১ লাখ টাকা মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। এরপর থেকে লোকসানে পড়েছে  এ কোম্পানি। পরে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯ কোটি ১২ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে কোম্পানিটি। এ ধারা চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরেও দৃশ্যমান। চলতি অর্থবছরের অর্ধ-বার্ষিক পর্যন্ত সময়ে প্রায় চার কোটি ৫২ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে ওসমানিয়া গ্লাস।

আলাপকালে উসমানিয়া গ্লাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদুল বারী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে উৎপাদন ও গুণগত মান কমছে। বাজারে চাহিদা থাকলেও ছয় মিলিমিটারের বেশি ঘনত্বের কাচ আমরা উৎপাদন করতে পারছি না। পাশাপাশি  প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কাচের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছি। মূল্য ছাড় ও  ক্রেতাদের কমিশনও দিতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে সরকারি নতুন বেতন কাঠামোর কারণে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে। এসব কারণেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি। সংকট উত্তরণে কারখানার আধুনিকায়নের মাধ্যমে খরচ কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন পণ্যের বিকল্প নেই। আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে, বর্তমানে দুই থেকে ছয় মিলিমিটার ঘনত্বের কাচ উৎপাদন করছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন কোম্পানিটি। পুরোনো প্রযুক্তির কারণে কাচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১৫ লাখ বর্গফুট কাচ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৪৬ লাখ ৮৩ হাজার বর্গফুট কাচ উৎপাদন করতে পেরেছে উসমানিয়া গ্লাস। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। একই কারণে উৎপাদিত কাচের গুণগত মানও কমছে। এ কারণে দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়ছে।

এদিকে দিন যতই যাচ্ছে, কাচ উৎপাদনে নতুন নতুন কোম্পানি ও আধুনিক প্রযুক্তি আসছে। ফলে এ অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না উসমানিয়া গ্লাস। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নাসির গ্লাস, পিএইচপি গ্লাস ও এমইবি গ্লাসের উৎপাদন খরচ ওসমানিয়া গ্লাসের উৎপাদন খরচের তুলনায় কম। বাজার দখল করতে এ কোম্পানিগুলো কাচের দাম কমিয়েছে। আর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে দুই বছরে কাচের দাম প্রতি বর্গফুটে গড়ে ছয় টাকা কমাতে বাধ্য হয়েছে উসমানিয়া গ্লাস। পাশাপাশি মূল্যছাড় ও বিক্রেতাদের কমিশনের পেছনেও বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব কারণে বিক্রি বাড়লেও লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে কোম্পানিটি। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো হলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তারা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, সর্বশেষ অর্থবছরে মোট কাচ বিক্রি থেকে আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় চার লাখ টাকা বেড়েছে। এর বিপরীতে কমিশন ও মূল্য ছাড়ের পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই কোটি ছয় লাখ টাকা। এ সময় কমিশন ও ছাড়ের কারণে প্রায় ৬৩ লাখ টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে। অথচ এর আগের বছরের একই সময়ে প্রায় ২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বিক্রি আয়ের বিপরীতে কমিশন ও ছাড় হিসেবে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছিলো কোম্পানিটি। মূল্য ছাড় ও কমিশনের কারণে এক বছরে বিক্রয় থেকে আয় কমেছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা কমেছে। অন্যদিকে এক বছরে কোম্পানিটির উৎপাদন খরচ প্রায় তিন কোটি ৩৩ লাখ টাকা বেড়েছে। পণ্যের মূল্য ছাড়, কমিশন আর উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ওসমানিয়া গ্লাসের পরিচালন লোকসান আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকের বেশি বা প্রায় চার কোটি টাকা বেড়েছে।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওসমানিয়া গ্লাস সাত কোটি ৯১ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে, যা এর আগের (২০১৪-১৫) অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ছয় কোটি ৭১ লাখ টাকা বেশি। আর চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় চার কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিচালন লোকসানে রয়েছে কোম্পানিটি।

কোম্পানির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান কমে যাওয়া, পণ্যের বৈচিত্র্য না থাকা ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার কারণে গত এক দশক ধরে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে ওসমানিয়া গ্লাস।

উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির লোকসানের কারণে সর্বশেষ দুই অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ হারে বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট প্রায় এক কোটি ৪৩ লাখ শেয়ারের ৫১ শতাংশই বিসিআইসির হাতে রয়েছে। এর বাইরে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে আট দশমিক নয় শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০