Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 4:58 am

মুন্সীগঞ্জে সেন আমলের রাজবাড়ি

মুন্সীগঞ্জ সদরের রঘুরামপুরে বৌদ্ধবিহার ও টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বর বৌদ্ধনগরী আবিষ্কারের পর এবার রামপালের বল্লালবাড়িতে আবিষ্কৃত হলো সেন আমলের রাজবাড়ি। ধারণা করা হচ্ছে, রাজবাড়িটিতে রাজা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ ও মন্দির রয়েছে। দুই দিনের পরীক্ষামূলক খননেই মাটির নিচে চাপা থাকা প্রায় আটশ বছরের পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন খননকারীরা।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, মুন্সীগঞ্জ সদরের রামপাল ইউনিয়নের বল্লালবাড়ি এলাকাটি বাংলার সেন রাজাদের রাজধানী ‘বিক্রমপুর’ হিসেবে পরিচিত হলেও এখানে রাজবাড়ির কোনো চিহ্ন দৃশ্যমান ছিল না। দখলদারিত্ব ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটির চারদিকে পরিখাবেষ্টিত এমন বিশাল বাড়িটি আবিষ্কারের জন্য এর আগে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননও হয়নি। ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধারে ২০১১ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব জরিপ ও খননকাজ শুরু হয়। এতে রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয় হাজার বছরের বৌদ্ধবিহার ও টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বরে বৌদ্ধমন্দির। এরপর এবার একই ইউনিয়নের বল্লালবাড়ি এলাকায় আবিষ্কৃত হলো সেন আমলের রাজবাড়ি।
খননকাজের তত্ত্বাবধানে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বল্লালবাড়িতে খননকাজে পাওয়া পাথরগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কোনো স্থাপত্যের ভাঙা টুকরা হতে পারে। বড় আকারের খননকাজ করলে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তার মতে, খননকাজ শতভাগ সম্পন্ন হলে একটি রাজধানীর চিত্র ফুটে উঠবে। তিনি আরও বলেন, গত ২১ জানুয়ারি থেকে দুই দিনের পরীক্ষামূলক খননকাজ করা হয়। চীন ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দল যৌথভাবে এ কাজে অংশ নেয়। বল্লালবাড়ি খননে যে স্তর পাওয়া গেছে, তাতে এখানে রাজা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িটির চারদিকে পরিখা আছে। প্রাসাদের নিরাপত্তায় কৃত্রিমভাবে এটা নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে পরিখার ওপর এখন রাস্তা ও ভবন রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদরের রামপাল কলেজের পেছন থেকে পরিখাটি স্পষ্ট দেখা যায় বলে জানান তিনি। এই পরিখা দেখে বোঝা যায়, প্রাসাদটি একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিল। জায়গাটি এখন ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। মালিকদের অনুমতি নিয়েই খননকাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বল্লালবাড়িতে পরীক্ষামূলক খনন শুরু হয়। ২১ জানুয়ারিতে মাত্র ৯ বর্গমিটার খননেই বেরিয়ে আসে প্রাচীন বসতির গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য স্থাপত্যের চিহ্নরেখা। প্রথম দিনই উম্মোচিত হয় সেন রাজবাড়ির প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। লেনিন আরও বলেন, খননকালে প্রাচীন ইটের গাঁথুনি, মৃৎপাত্র ও চারকোলসহ আরও কিছু জিনিস পাওয়া গেছে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রত্ননিদর্শনের বয়স বা নির্মাণকাল নির্ধারণ করার জন্য চারকোলের কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এখান থেকে পাওয়া চারকোল দিয়েও তাই সহজে এর বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব। এ খননকাজের শুরুতে প্রায় ৮০০ বছরের বাঙালির ইতিহাসের একটি চমকপ্রদ অধ্যায় আবিষ্কারের সূচনা হলো। সেন রাজবাড়ি আবিষ্কারের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে আরও একটি অধ্যায় যুক্ত হতে যাচ্ছে।
ড. সুফী মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এখানে বর্গাকৃতির একটি দুর্গ ছিল। যতটুকু খনন করা হয়েছে, তাতে স্থাপত্যের নমুনা বেরিয়েছে। এর সঙ্গে জরিপ মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, সেন রাজার বাড়িতে একটি প্রাচীরঘেরা দুর্গের মতো প্রাসাদ ও মন্দির ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানান, সংগ্রহকৃত চারকোলটি আমেরিকান ল্যাবরেটরি ‘বেটা’তে পাঠানো হবে। সেখানে কার্বন পরীক্ষা শেষে সংগ্রহ করা নমুনা কত বছর আগের তা জানা যাবে। ইতিহাসে বল্লাল সেনের একটি সময় রয়েছে। তাই দুই সময় মিলিয়ে অসাধারণ একটি তথ্য ইতিহাসে যোগ হতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের বজ্রযোগিনী ও রামপাল অঞ্চলে প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধারে ২০১১ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব জরিপ ও খননকাজ হাতে নেওয়া হয়। বৌদ্ধধর্মের পণ্ডিত ও বিশ্বের দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসেবে পরিচিত অতীশ দীপংকরের বাস্তুভিটার কাছে ২০১৩ সালে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি আবিষ্কৃত হয়। বিহারটি ‘বিক্রমপুর বিহার’ নামে পরিচিত।
জানা গেছে, আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের পাঁচটি ভিক্ষুকক্ষ এরই মধ্যে উম্মোচিত হয়েছে। একেকটি কক্ষের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ তিন দশমিক পাঁচ মিটার করে। ধারণা করা হচ্ছে, বৌদ্ধধর্মের জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকরের সঙ্গে এই বিহারের সম্পর্ক রয়েছে। আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের নকশা অনুযায়ী এর একটি প্রাচীর দেওয়াল উত্তর দিকে ও আরেকটি দেওয়াল পশ্চিম দিকে ধাবমান বলে নিশ্চিত হয়েছেন খননকারীরা। উম্মোচিত ভিক্ষুকক্ষগুলো বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত।
বৌদ্ধবিহার আবিষ্কারের পর খননকাজ বাড়ানোর পর টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বর গ্রামে আবিষ্কৃত হয় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধনগরী। সেখানে তিন বছর ধরে চলা খননে বেরিয়ে আসে বৌদ্ধমন্দির, অষ্টকোনাকৃতি স্তূপ, ইটনির্মিত নালা, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এই খননে দেড় হাজার বছর আগের বৌদ্ধযুগের নগরীর নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানান, খননকাজে জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ