নিজস্ব প্রতিবেদক: কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে দুরবস্থায় এখন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া ঋণ ফেরত পাচ্ছে না, তাই বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে বড় অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ছে। এতে অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মূলধনে সংকট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ কমাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ম পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উন্নতি দেখাতেও নির্দেশ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল রোববার প্রথম দফায় সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বৈঠকে এই বার্তা দিয়েছেন সংস্থাটির ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, দ্রুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক উন্নয়ন পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে, যাতে করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ কমে আসে। বৈঠকে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ কোম্পানির মূলধন সংরক্ষণ পরিকল্পনা জমা দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিগগির বাকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই নির্দেশনার আওতায় নিয়ে আসা হবে। যদিও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধন সংকট নেই বলে জানিয়েছেন মুখপাত্র।
তিনি আরও বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা একেক রকমের। তাই সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনাগুলো তাদের কাছ থেকে আসা উচিত। তবেই সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দৃশ্যমান উন্নতি দেখতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সভায় জানানো হয়, দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিতে খেলাপি ঋণ ৩২ শতাংশের বেশি। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৯৬ কোটি টাকা বা প্রায় তিন শতাংশ বেড়েছে। এই খাতে জুনের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মার্চের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ। বর্তমানে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশের বেশি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, কিছুদিন আগে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সুবিধা দিয়েছে। তাতে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা পরিশোধ করলে কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হবেন না। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ সুবিধা রাখা হয়নি। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এছাড়া অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাতই এখন তার জের টানছে। পি কে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি বাড়ে, দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের সংকট।
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়েই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।