নিজস্ব প্রতিবেদক: দুই মাস মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্টে তা আবার বেড়েছে। এ সময় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, আগস্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। এ সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল রেকর্ড ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে দুই বছরের মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্য সর্বনিন্ম পর্যায়ে রয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা গেছে। যদিও অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি রয়েছে সহনীয় পর্যায়ে।
সূত্রমতে, সরকারের প্রত্যাশা ছিল আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমবে। ২৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভার (একনেক) পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জোর করে কমানো যায় না। কার্যকর নীতি নিতে হবে। আমি ঝুঁকি নিয়ে বলতে পারি, চলতি আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৪ পয়েন্ট কমবে।’
যদিও বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর মানে, ২০২২ সালে আগস্টে একজন মানুষ যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কিনতেন, চলতি বছরের আগস্টে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৯২ পয়সা।
বিবিএসের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, আগস্টে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মানে, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে। উভয় ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ে ১০ শতাংশের নিচে ছিল।
যদিও বিশ্বের প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর দাম গত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এখন সর্বনি¤œ পর্যায়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আগস্টের সূচক এমন তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটির খাদ্য মূল্যসূচক আগস্টে ১২১ দশমিক ৪-এ নেমে এসেছে, যা জুলাইয়ে ছিল ১২৪ পয়েন্ট। এই সূচক ২০২১ সালে মার্চের পর আর এতটা কমেনি।
এর আগে ২০২২ সালের মার্চে খাদ্য সূচক সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছিল। সেই তুলনায় আগস্টে সার্বিক সূচক ২৪ শতাংশ কমেছে। দুগ্ধজাত পণ্য, তেলবীজ, মাংস, দানাজাতীয় খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের খাবারের দাম কমেছে।
খাদ্যশস্যের সরবরাহ ও চাহিদা-সম্পর্কিত একটি পৃথক প্রতিবেদনে এফএও চলতি বছর বিশ্ব শস্য উৎপাদনের পূর্বাভাস দিয়েছে ২ দশমিক ৮১৫ বিলিয়ন টন, যা আগের ধারণা করা ২ দশমিক ৮১৯ বিলিয়ন টনের থেকে সামান্য কম।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ার পরও গম বা ভুট্টার বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। ব্রাজিলের উদ্বৃত্ত উৎপাদন আর যুক্তরাষ্ট্রে ফসল তোলার সময় ঘনিয়ে আসায় এ দুই খাদ্যের দাম বরং কমেছে। ভোজ্যতেলের দাম কমেছে তিন দশমিক এক শতাংশ। আর দুগ্ধজাত পণ্যের দাম চার শতাংশ কমেছে।
যদিও ব্যতিক্রম চালের বাজার। ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় বিশ্ববাজারে এর দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে চালের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে। শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত চালের রপ্তানি বন্ধ করার পর বিশ্বব্যাপী চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদনে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও চলতি আমন ও বোরোর ফলন ভালো হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের চাল আমদানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। এতে ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার তেমন কোনো প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। তবে গত মাসে ডিম ও আলুর দাম অনেক বাড়ে। এর মধ্যে ডিমের দাম রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান শেয়ার বিজকে বলেন, গত মাসে ডিম ও আলুর দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে সরবরাহ কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে, যা খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে বিবিএস বলছে, দেশে সার্বিক খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ের ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে কমে আগস্টে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও শহর এলাকায় এটি ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
চলতি বছরের আট মাসের মূল্যস্ফীতির ধারা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ ও মার্চে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হলেও মে মাসে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
এরপর জুনে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে হয় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে আগস্টে আবারও তা বেড়ে যায়। এছাড়া গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
যদিও শ্রীলঙ্কা গত আট মাসে তাদের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক পর্যায় থেকে অনেক কমিয়ে নিয়ে এসেছে। জানুয়ারিতে দেশটির সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা সামান্য কমে হয় ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ ও মার্চে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। এপ্রিলে তা অনেকটা কমে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও মে মাসে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
এরপর জুনে মূল্যস্ফীতি আরও অনেকটা কমে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। জুলাইয়ে দেশটি মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নামিয়ে আনে। এ সময় তাদের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আগস্টে তা আরও কমে হয় ৪ শতাংশ।
তথ্যমতে, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বর্তমানে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি পাকিস্তানে। আগস্টে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। নেপাল ও ভারতে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশ দুটির আগস্টের তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। অন্যান্য দেশের মধ্যে ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় আগস্টের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশ এবং মালদ্বীপে জুলাইয়ে ছিল ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর বাইরে আফগানিস্তানে কোনো মূল্যস্ফীতি নেই। দেশটিতে জুনে উল্টো মূল্য সংকোচন ছিল। তবে এর পরের তথ্য দেশটি প্রকাশ করেনি।