মূল্যস্ফীতির চাপে কমছে ব্যাংকের আমানত

রোহান রাজিব: উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাংকগুলো আমানত হারাচ্ছে। কারণ এখন মানুষের ব্যাংকে টাকা রেখে বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। বরং জমানো টাকার ওপর ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক পরিশোধের পর যে পরিমাণ মুনাফা হয়, মূল্যস্ফীতি তার থেকে বেশি। ফলে ব্যাংকে আমানত না রেখে নিজেদের কাছে টাকা রেখে খরচ করছেন মানুষ। গত দুই মাসে ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে দুই হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই তারা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এছাড়া ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে অধিকাংশ মানুষ সঞ্চয় করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট মাসে শেষে ব্যাংক খাতের আমানতের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা, যা গত জুনে ছিল ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি  অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সময়ে দুই হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার আমানত কমেছে।

বর্তমান ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ আমানত রয়েছে, এর বেশিরভাগ অংশই আছে ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে। ব্যাংকের বাইরে অর্থাৎ দেশে মানুষের হাতে এখন প্রায় দুই লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা রয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল দুই লাখ সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা সাড়ে ১৩ ভাগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক মাসের অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় ততটা বাড়েনি। তাই মানুষ সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাই আমানত কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, অধিক মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যাংকের সুদহারের বেঁধে দেয়া ক্যাপ ছেড়ে দেয়া উচিত। কারণ এ সময়ে যদি ঋণের প্রবৃদ্ধি না কমানো যায়, তাহলে চাহিদার চাপ কমবে না। আর চাহিদার চাপ না কমলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকবে।

দেশের অনেক নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। এটা প্রমাণিত হয় ব্যাংকগুলোর ২০২১ সালের জুনের প্রবৃদ্ধি থেকে ২০২২ সালের প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালেই। ২০২১ সালের জুনে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ২০২২ সালের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যমতে, গত জুনে বাংলাদেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৫৬ শতাংশ, জুলাইয়ে ৭.৪৮ শতাংশ, আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। যদিও সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ১০ শতাংশে। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরÑএ দুই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। তাতে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়।

এর আগে আগে আমানতের সুদহার ৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। এ কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলে আমানতের সুদের হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতের হার তলানিতে নেমে যাওয়ার কারণে সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতির নিচে হবে না। সেই হিসেবে এখন আমানতের সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশে উঠে গেছে। এদিকে গত আগস্টে ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার থেকে আমানতের সুদের হার বাদ দিলে যা থাকে, সেটাই হচ্ছে প্রকৃত সুদের হার।

এছাড়া মানুষ এখন জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর একটি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিতে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) ১৪ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র জমা বা বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ১৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০১ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রেকর্ড ৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা কম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের জামানো টাকার ওপর একটা প্রভাব পড়ছে। এছাড়া ইম্পোর্ট সেটেলমেন্ট করতে আগে যে পরিমাণ টাকা লাগত, এখন তার চেয়ে বেশি লাগছে। কারণ বিশ্ববাজরে পণ্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য মানুষের ওপর দুই দিকেরই প্রভাব রয়েছে। তাই মানুষ এখন সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এ জন্য ব্যাংক আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে।

জানা যায়, পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। গত ৬ আগস্ট থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের লিটারে ৩৪ টাকা এবং পেট্রোল ও অকটেনে ৪৬ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছিল। গত ২০ বছরে একসঙ্গে এত বেশি পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর রেকর্ড আর নেই। এরপর পরিবহন ভাড়া বেড়েছিল সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ।

এর আগে গত নভেম্বরে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। ওই সময়েও পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ। তাই আগস্টের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। আর এসবের প্রভাব পরে ব্যাংক খাতের আমানতের ওপর।

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ডলার খরচ হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে বলে তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তারল্য সংকট দেখা দেয়ায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অধিক পরিমাণে টাকা ধার নিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। দুই মাস আগেও এ খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। আগস্ট শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৫৯ হাজার কোটি, বেসরকারি ব্যাংকে ৮৬ হাজার কোটি এবং বিদেশি ব্যাংকে ২৯ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়লে আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। তারই একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তবে যে পরিমাণ আমানত কমেছে এটা বেশি প্রভাব ফেলবে না। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম কাজ করছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০