মো. মাঈন উদ্দীন : দীর্ঘদিন ধরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবস্থায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। মানুষ কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। প্রায় ১৫ মাস ধরে একটানা মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। সুদ হার ও টাকার সরবরাহ পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২৪-এর ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদ হারের কোনো পরিবর্তন নেই।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ডলারের দামের ও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকায় ধরে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে আটকে রাখা, ছয়-নয় সুদহার চালু রাখাকে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়। ডলারের রিজার্ভ বাড়াতে হলে আমাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের যে ব্যাপক বেকার, শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত জনবল রয়েছে তা বিদেশে পাঠাতে হবে। তারাই আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও রেখে যাবেন। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ বা বিনিয়োগ পাওয়ার মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানো যেতে পারে।
এ দিকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহেও সøথ গতি দেখা দিয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। কারণ হুন্ডিওয়ালাদের খপ্পরে পড়ছে রেমিট্যান্স ব্যবসা। হুন্ডিওয়ালারা অবৈধ ব্যবসায়ে অর্থ জোগানোর উদ্দেশ্যে বিদেশে ডলার সংগ্রহ করে বেশি দামে। ঘরে ঘরে মুহূর্তের মধ্যে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বেশি টাকা পাচ্ছেন। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। কিন্তু ইদানীং বৈদেশিক ঋণের বা বিনিয়োগের তেমন ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রবাসীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দ্রুত রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের রপ্তানির বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চা, হিমায়িত চিংড়ি, বিভিন্ন ফল ও সবজি, আলু, কপিসহ কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে কৃষি খাতের সমস্যাগুলো দূর করে দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উৎপাদন জোরদার করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও দেশের মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখতে হলে কৃষি উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের পাঁচ বছর বয়সি ৩৯ লাখ শিশু খর্বাকার। তাই দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিতে প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানোর জন্য সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অনাবাদি জমি কৃষি উৎপাদনের কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি, মৎস্য ও পশু পালন জোরদার করার জন্য যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। চাকরির পেছনে যুবকদের না ঘুরে ধান উৎপাদন, সবজি ও ফল উৎপাদন এবং মৎস্য খামার স্থাপনসহ হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার করে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে কৃষি থেকে শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ হবে।
কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ উন্নত করে বিদেশেও রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। ব্যাংকের সুদহার যে ঊর্ধ্বমুখী তাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে মনে করা হলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আমদানি ঋণ পত্র খোলার ক্ষেত্রে কড়া কড়ি বা বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা দেয়া হয়। নতুুন মুদ্রানীতি আগের মতোই সংকোচন মূলক ।২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ের জন্য এ নীতি ঘোষণা করা হয়।
এ নীতিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, জুন ২৪ পর্যন্ত যা একই ছিল। তবে সরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত যা ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এজন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের মোট প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে ডলারের দাম ১১৭ টাকায় রাখার ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতে তা বাজারভিত্তিক করার ইঙ্গিত দেয়া হয়। আমদানি ঋণপত্রের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল করে শুধু গাড়ি, ফলমূল, ফুল, প্রসাধনী আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্রের বিপরীতে নগদ অর্থ জমা দিতে হবে। এর বাইরে অন্য পণ্য আমদানিতে অগ্রিম অর্থ জমা শিথিল করার কথা বলা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কয়েকটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য বাধা। অদূর ভবিষ্যতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি,বিনিময় হারের অস্থিরতা, রাজস্ব স্বল্পতা ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বলা যায় বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বিতভাবে অন্যান্য কৌশল ও নীতি নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কোথায় কোথায় সমস্যা ও বাধা তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যবস্থার ও বাজার ব্যবস্থাপনার চেইন সাবলীলভাবে চালাতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের হাত থেকে বাজার ব্যবস্থাপনার মুক্ত রাখতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থা সহজীকরণ করতে হবে।
গ্রাম ও শহরের মধ্যে পণ্য মূল্যের ব্যবধান কমাতে হবে। অনাকাক্সিক্ষত পণ্য মজুত বন্ধ করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাজস্বনীতি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। বাস্তবতা হলো গত অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও তা কমাতে পারেনি। বরং তা ৯ শতাংশের ওপরেই থেকেছে। এবারও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারের লক্ষ্য থাকবে ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৭ শতাংশে আনার কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্যতায় ভাটা পড়তে পারে।
নতুন মুদ্রানীতিতে প্রকৃত বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, গত জুনে যা ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে অফসোর ব্যাংককিং, বিদেশ ফেরতদের বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলা ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমতে ও রিজার্ভ বাড়বে। তবে এটা নির্ভর করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মতৎপরতার ওপর। তবে ডলার বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হলে বাজারে নগদ টাকার সংকট দেখা দিতে পারে।