মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়ে আসছে মেগা বাজেট

মাসুম বিল্লাহ ও রহমত রহমান: স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বা কেন্দ্রীয় সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়ে হয়ে আসছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা গেলে তার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়, যেমন দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়গুলো অর্জন করা সম্ভব হয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে দেশে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে পারাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বিবেচনা করে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে চলেছে সরকার।

আগামীকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। এবার নতুন বাজেটের আকার হবে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। মেগা এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হবে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অপরদিকে, আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর থেকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। আর এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কর ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায় সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আগামী বাজেটে করহার বাড়ানো হচ্ছে, যা বড় একটি প্রাপ্তি। নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করে কর আদায় বাড়ানো হবে।

সূত্রমতে, আগামী বাজেটে সরকারের ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে চার লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হবে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ খাতে ব্যয় হবে সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা। যেহেতু আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে। সেজন্য আমদানিকৃত পণ্যে বেশি করে ভর্তুকি দেয়া হবে। বিশেষ করে সার, খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, রপ্তানি পণ্য ও রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ব্যয় করা হবে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে মূলধনীয় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।

অপরদিকে, জিডিপি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে আগামী বাজেটে ঘাটতি (অনুদানসহ) হবে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের তুলনায় ব্যাংক ঋণ ১৯ হাজার ৪৭ কোটি ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ তিন হাজার কোটি টাকা বেশি নেওয়া হবে। এছাড়া ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আগামী বাজেটের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বেসরকারি ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, মোট ব্যয় জিডিপির ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ, মোট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং প্রাথমিক ঘাটতি জিপিডির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আর আগামী বাজেটে জিডিপির আকার হবে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।

সূত্রমতে, বাজেটে করহার বাড়ছে না। তবে আওতা বাড়াতে থাকবে বেশ কিছু নির্দেশনা। এ ছাড়া রাজস্ব ও রপ্তানি বাড়াতে কিছু কিছু খাতে করছাড় দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটা চমক হলো পোশাক খাতের মতো সব রপ্তানি খাতে করপোরেট কর ১২ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমানে এই হার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩০ শতাংশ। আর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ আছে, তা আগামী অর্থবছরে বহাল রাখা হচ্ছে না। যে কোনো কারণে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এতদিন যেসব কোম্পানি ওই ঋণের সুদ থেকে অব্যাহতি পেয়ে খুশি হতেন, তাদের জন্য আগামী বাজেটে দুঃসংবাদ আসছে। এতদিন তারা ওই মওকুফ হওয়া সুদের ওপর কর ছাড় পেলেও আগামী বছর থেকে ছাড় পাবেন না।

অপরদিকে, কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এটি বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাজারে ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে। পাশাপাশি মোবাইল সেট বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট নেই। ব্যবসা পর্যায়ে মোবাইল সেটের ওপর বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে মোবাইলের দাম বাড়তে পারে। আবার কয়েকটি খাতে ভ্যাট হার কমানো হচ্ছে। এর মধ্যে হোটেল-রেস্টুরেন্টের ভ্যাট কমানো হচ্ছে। বর্তমানে এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। অপরদিকে, জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশ করা হচ্ছে। ভ্যাট রিটার্ন দাখিলে (দাখিলপত্র) ব্যর্থতার জরিমানা ১০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা ও অনিয়মের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে।

অপরদিকে, আগামী বাজেটে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ই-টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (প্রাপ্তি স্বীকার বা আয়কর সনদ) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মূলত রিটার্ন দাখিল বাড়ানো ও করযোগ্য ব্যক্তিদের করের আওতায় আনতে বাজেটে এই ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৪০ ধরনের সেবা নিতে হলে ই-টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক।

সূত্রমতে, আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলে বিপুলসংখ্যক করদাতা করনেটের বাইরে চলে যেতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকে সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। সারচার্জ বা সম্পদ কর হারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। হাঁস-মুরগির খামারিদের কর বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে হাঁস-মুরগির খামারের মালিকদের ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। এটি কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া আগের নিয়মেই হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য চাষ থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর দিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০