নিজস্ব প্রতিবেদক:মুদ্রানীতির যেসব মূলনীতি রয়েছে তার অন্যতম হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি খাতের ঋণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখা। তবে এবার মুদ্রানীতিতে অনেকটা উল্টো পথে হেঁটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ রাখা হয়নি। একই সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে বেসরকারি খাতের যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে মুদ্রানীতিতে ঘোষিত বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ঘোষিত বাজেট এবং মুদ্রানীতি অনেকটাই দ্বিমুখী প্রবণতার দিকে ধাবিত। পাশাপাশি নি¤œমুখী রিজার্ভ বাড়াতে ডলারের জোগান বৃদ্ধি করা নিয়েও মুদ্রানীতিতে কোনো উদ্যোগ উল্লেখ করা হয়নি।
গতকাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়া হয়েছে। কমানো হয়েছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা ঠিক আছে। তবে এটা খুবই ক্ষুদ্র বা শিশু সুলভ পদক্ষেপ। তাই এখান থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
এবার মুদ্রানীতি ঘোষণায় বলা হয়েছে, নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদহার সীমাও তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুদহার সীমার বদলে প্রতিযোগিতামূলক ও বাজারভিত্তিক সুদহার কার্যকর হবে, যদিও তার মার্জিন থাকবে। এর মধ্য দিয়ে সমাজে অতিরিক্ত মুদ্রার সরবরাহে রাশ টানা হবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্তও কাজে আসবে বলে তারা মনে করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান জানান, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারবে। এটাই হবে সুদের সর্বোচ্চ হার। এতে করে ব্যাংকঋণের ৯ শতাংশ সীমা উঠে গেছে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহারের সীমাও তুলে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে গড় সুদ ছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ। নতুন নিয়মে ব্যাংকঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ব্যাংকঋণের ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এই সীমা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটিও রাজনৈতিক। আমাদের কৃতিত্ব আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। যখন এই সীমা দেয়া হয়েছিল, তখন ব্যাংকগুলোর সুদ ১৮ শতাংশে উঠেছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। এখন বিদেশি ঋণের সুদ ৯-১০ শতাংশ। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তার খরচ আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে।’
মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো হার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এতে রেপো হার ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠবে। সেই সঙ্গে রিভার্স রেপো হার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে ৪ দশমিক ২৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তা হবে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলো যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কমে তাই নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সরকারের ঋণও এতে ব্যয়বহুল হবে। ফলে বাজারে টাকা কম যাবে, ডিমান্ড কমে আসবে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
গত মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নিÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একই ধরনের মুদ্রানীতি প্রণয়ন করছে। মূল্যস্ফীতি প্রাধান্য দিয়েই এটি করা হচ্ছে। কেউ করতে পারছে, কেউ পারছে না। তাই এটা ফেল বা পাসের ব্যাপার না। এটা নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমরা চেষ্টা করি একটা পলিসি দিতে। সেটা যদি কার্যকর না হয়, আরেকটা পলিসি নিয়ে আসি। আমাদের মূল্যস্ফীতি সাপ্লাই সাইড থেকে আসা। এটা গতবারও মেইনটেইন করতে পারিনি। তাই এবারের মুদ্রানীতিতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে।’
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, গত মুদ্রানীতিতে যা ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ, গতবার ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬.৯ শতাংশ, গতবার যা ধরা হয়েছিল ১৬.৯ শতাংশ।
মুদ্রানীতির যে প্রক্ষেপণ চলতি জুন মাস শেষে অভ্যন্তরীণভাবে ধরেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তার কতটা অর্জন হয়েছে, সে তথ্যও জানানো হয় মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও মে মাস শেষে অর্জন হয়েছে ৪৩.৩ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ, হয়েছে ১১.১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ, আর গত মে পর্যন্ত হয়েছে ১৬.৭ শতাংশ।
জাতীয় বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে সরকার।
বাজেটে ঘোষিত সাড় সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবেÑএ বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, সাড়ে ১২ বিয়িলন ডলার বিদেশি লোন বাজেটে ধরা হয়েছে। আর যেসব ইনভেস্টমেন্ট চলে গেছে, তা আবার ফেরত আসবে। একই সময়ে এফডিআই যদি আসে তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এটা অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকেও আসতে পারে। আবার বিদেশ ঋণ থেকে আসতে পারে।
বেসরকারি ঋণের গ্রোথ কমিয়ে কীভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হবেÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার ঋণ নেয় এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়ন করতে। ঋণ নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও বিভিন্ন ঋণ শোধ করা হয় না। এগুলো রেভিনিউ থেকে করা হয়। তাই এডিপিতে যেটা করা হয় সেটাও ইনভেস্টমন্ট। এডিপি ইনভেস্টমেন্ট না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। তাই সরকারের বিনিয়োগ বেসরকারি খাতকেও প্রভাবিত করে। তাই আমরা সরকারের বিনিয়োগ কমানোর পক্ষে না।’
রিজার্ভ ও এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে চাপ রয়েছে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘দুইটা সেক্টরে আমাদের প্রেশার রয়েছে। একটি হলো একচেঞ্জ রেট, অন্যটি রিজার্ভ। এ দুইটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে নজর দেয়া হয়েছে। আপাতত আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তা চাপ কমানোর কথা বলা হয়।’
আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমালেও সেটাকে আমলে নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘এর আগে মুডি’স যে রেটিং দিয়েছিল, সেটা ২০১২ সালের দিকে। সে সময় আমাদের অর্থনীতি যেমন ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ইতোমধ্যে আমাদের ডলারের রিজার্ভ বা মজুত ৪৮ বিলিয়নেও উঠেছিল। মাথাপিছু আয়ও গত কয়েক বছরে বেড়েছে। কিন্তু তখন তারা আমাদের রেটিং বাড়ায়নি।’
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘যেসব কারণে এখন রেটিং কমানো হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। যেটা করা হয়েছে সেটাকে পিওর ইকোনমিক রিপোর্টিং বলা যাবে না। এটা ভূরাজনৈতিক কারণে হয়েছে। আমাদের রেটিং কমানোর মতো কিছু হয়নি। এখন দেশের অর্থনীতিতে ডলারের সংকট ও রিজার্ভের সমস্যা ছাড়া বড় কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো ভালো আছে।’
কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সংকট ও জরিমানা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নর জানান, ‘কোনো ব্যাংকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা চাই যারা সমস্যায় আছে তারা আবার ব্যাংক ব্যবসায় ফিরে আসুক। বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে তাদের ব্যবসায় ফেরানোর চেষ্টা করছি আমরা। আশা করি, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের জরিমানা পরিশোধসহ ব্যবসায় ফিরে আসতে পারবে।’
সার্বিক বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানোর বিষয়ে মুদ্রানীতিতে কিছু বলা নেই। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার রেট দিয়ে বেচাকেনা করা হবে না, তা বলা হয়েছে। তাই বলা যায়, ডলারের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা থেকেই যাবে। এতে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি কমবে।