Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:23 pm

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার ও ঋণের সুদহার ফের বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ডিসেম্বর শেষে আট শতাংশ এবং ২০২৪ সালের জুন শেষে ছয় শতাংশে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য সব ধরনের নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদহারের মার্জিন ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়। আজ সোমবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। গতকাল রোববার পুনর্গঠিত মনিটরি পলিসি কমিটির (এমপিসি) প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়, যা আগে ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে।

নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক উচ্চ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। একই সঙ্গে নীতি সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর সুদ বাড়িয়ে তা তুলে নেয়।

এছাড়া ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন থেকে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করতে পারবে। চলতি বছরের ২৩ জুলাই বাজারভিত্তিক এ সুদনীতি প্রচলন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন থেকে স্মার্ট রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ মার্জিন যোগ করার নীতির চর্চা হয়ে আসছিল। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত ৬ অক্টোবর ব্যাংক ঋণের সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। গতকাল আরও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

ডলারের বিনিময়হারকে বাজারমুখী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর এখন কোনো বিকল্প দেখছি না। ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লে আগের চেয়ে কম ঋণ গ্রহণ করবে মানুষ। পক্ষান্তরে যাদের কাছে টাকা রয়েছে, বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় তারা ব্যাংকে টাকা রাখবে। এতে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রয়োজনে জিডিপি কিছুটা কমবে। তারপরও সবার আগে মূল সমস্যাতে নজর দিতে হবে। এরই মধ্যে আমরা ক্ষুদ্র ও কৃষিঋণ বিতরণের গুরুত্ব বাড়িয়েছি। এছাড়া পদ্মা সেতু, বিভিন্ন রেল ও সড়কপথের উন্নয়নের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান সহজ হবে। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে নির্বাচনে ব্যাংক থেকে ঋণ কম বের হতে পারে বলেও আশা প্রধান অর্থনীতিবিদের।

এই দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান, অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. এজাজুল ইসলাম অংশ নেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময়হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, যেমন নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদান স্থগিতকরণ, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তদারকি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে কমিটির সদস্যদের অবহিত করে।

কমিটির সদস্যরা সভায় এসব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবং ব্যাংক খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিনিময়হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সভায় ঐকমত্য পোষণ করা হয়।

সভায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নীতি পদক্ষেপ, বিশ্ববাজারের পণ্য মূল্যে নিম্নমুখী ধারা, আসন্ন আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবং শীতকালীন ফসল সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে আট শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাশাপাশি বিনিময়হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নীতি সুদহার বাড়ানোর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে গত অক্টোবর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।