মেঘনায় গ্রামঘেঁষে বালি উত্তোলন, ভাঙন আতঙ্ক

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ: বর্ষা মৌসুমের সামনে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে গ্রামঘেঁষে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের মহাযজ্ঞ চলছে। মেঘনায় বালি উত্তোলনের বৈধ ইজারা নিয়ে গ্রামঘেঁষে বালি উত্তোলন চালাচ্ছে ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন গজারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহ। আর এ বালি উত্তোলনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক।

মেঘনা তীরের এ গ্রামের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। বর্ষার সামনে ওই জমিতে জোয়ারের সময় হাঁটুপানি বিরাজ করে। দিনের বেলায় গ্রামলাগোয়া ওই জমি থেকে কিছুটা দূরেই ড্রেজারের মাধ্যমে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। আর রাতের আঁধারে জমিঘেঁষেই বালি উত্তোলনের কর্মযজ্ঞ চলে।

সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নের চরকালীপুরা গ্রামের একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে বালি উত্তোলনের এ চিত্র পাওয়া গেছে।

এ সময় তারা গ্রামঘেঁষে বালি উত্তোলনের অভিযোগ তোলেন। তারা জানান, ইজারা প্রতিষ্ঠানকে তারা চেনেন না। তবে ইজারা প্রতিষ্ঠান ও উপজেলা চেয়ারম্যান মিলেমিশে এ বালি উত্তোলন করছেন।

এদিকে উপজেলার চরকালীপুরা, নয়ানগর, রমজানবেগ ও ষোলোআনি গ্রামসংলগ্ন মেঘনার বালি মহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ বালি মহালের ১২৮ একর জুড়ে মেঘনাবক্ষে বালি উত্তোলন করা যাবে। এ বালি মহালটি ইজারা পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। সম্প্রতি ওই মহালে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে বালি উত্তোলন শুরু করে ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর দিলকুশার ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মেঘনায় বালি উত্তোলনের কাজ দেখভাল করে আসছেন গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহ।

গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হলে মেঘনা তীরের ওই গ্রামঘেঁষে বালি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার পেছনে ওই উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম উঠে এসেছে।

উপজেলার চরকালীপুরা গ্রামের বাসিন্দা আব্বাস প্রধানের স্ত্রী নার্গিস আক্তার (৫০) জানান, এ গ্রামের একেবারে নদীঘেঁষে রয়েছে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প। ১২ বছর আগে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ১২০টি পরিবারের। এছাড়া এ গ্রামে আরও ২০০টি পরিবার বসবাস করে আসছে বংশ পরম্পরায়। তিন শতাধিক পরিবারের বসবাসের এ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার রোজগারের একমাত্র উপায় মেঘনা নদীতে মাছ শিকার।

এককথায় অধিকাংশ পরিবার হতদরিদ্র। গ্রামের ওই নারী বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনেই গ্রামের জমিগুলোর ধারেই বালি উত্তোলনের জন্য ড্রেজার লাগাচ্ছে। চোখে দেখছি, ভয়ে বাদ সাধতে পারি না। কিছু বলতে গেলেই মারতে আসে। ভয়ে আছি কখন জানি গ্রামসুদ্ধ কেটে নিয়ে যায় বালিখেকোরা। এমন করে বালি কাটলে তো বর্ষায় আমাদের ঘর-বাড়িই ভেঙে নিয়ে যাবে রাক্ষুসী মেঘনা।’ গ্রামের জুলহাস প্রধান (৫৫) বলেন, ‘বর্ষা এলেই নদীভাঙনের ভয়ে আমাদের বুক কাঁপে। এখন আবার গ্রামের কাছেই ড্রেজারে বালি কাটছে। আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান জিন্নাহ বড় একটা কোম্পানির সঙ্গে মিলে এ বালি উত্তোলন করছে। যেভাবে ড্রেজার লাগাচ্ছে, তাতে গ্রামের জমি ও বসতভিটা এ বর্ষাতেই ভেঙে যাবে।’

গ্রামের আক্কাস প্রধান (৬০) জানান, গ্রামের পাশে তার জমি রয়েছে ১২০ শতাংশ। জমির পরই মেঘনা নদী। আর ওই জমির কাছে মেঘনায় বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজারের মাধ্যমে এ বালি উত্তোলন করায় ভাঙন আতঙ্ক বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করার সাহস নেই আমাদের। প্রতিবাদ করলে ইজারাদারের লোকজন চড়াও হয়। এভাবে বালি কাটলে এ বর্ষায় মেঘনায় ভাঙন দেখা দেবে। আমার ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাবে।’

গ্রামের মামুন প্রধানের স্ত্রী নাজনীন (২১) বলেন, ‘রাতে ঘুম আসে নাÑকখন জানি ড্রেজারে জমিসুদ্ধ আমাদের বসতভিটা কেটে নিয়ে

যায়।’

তবে গ্রামঘেঁষে ড্রেজারের বালি উত্তোলনের কথা অস্বীকার করেছেন গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহ।

তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে ইজারা পেয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ রয়েলিটি দিয়েই বালি কাটা হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানেই বালি কাটা হচ্ছে, তীরঘেঁষে নয়। আপনারা সরেজমিনে ঘুরে দেখে যান।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা আপনাদের গ্রাম না। এটা আমার গ্রাম, আমার ইউনিয়ন এবং আমার জš§স্থান।’

বালি উত্তোলন কাজে ইজারা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, ‘জড়িত থাকলে কী হয়েছে। ব্যবসা তো সবাই করে। তবে আমার গ্রাম বিলিয়ে দিয়ে ব্যবসা করব না।’

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন বলেন, সীমানা অতিক্রম করে বালি কাটার কথা শুনেছি। তাৎক্ষণিকভাবে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে, যাতে নির্ধারিত সীমানার বাইরে বালি কাটা না হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০