জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষীপুর: মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা বিশাল চরে হাজার একর জমিতে চাষ হয়েছে সয়াবিন বীজ। ল²ীপুরে অসময়ে উৎপাদিত এ কাঁচা সয়াবিনের পুরোটাই বীজ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এ বীজ সয়াবিন সংগ্রহ, মাড়াইসহ ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষি। এ অঞ্চলের কয়েকটি চর থেকে অসময়ে উৎপাদিত সয়াবিনের পরিমাণ ১০ হাজার টনেরও বেশি, যার বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর এ বীজ সয়াবিন উৎপাদনে জড়িয়ে আছে চরের ভ‚মিহীন পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। কাঁচা সয়াবিন দ্বিগুণ দামে বিক্রি হওয়ায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। ফলে নদীর বুকে জেগে ওঠা বিশাল চরাঞ্চলগুলোতে সয়াবিন বীজ উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, এ অঞ্চলের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে এবং বিএডিসি থেকে সয়াবিনের বীজ সংগ্রহ করেন। পরে পৌষ মাসে এসব বীজ বুনে সয়াবিনের আবাদ শুরু করেন। জেলার চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর ও চরইন্দুরিয়ার বিশাল অঞ্চলজুড়ে কৃষকরা আশ্বিন মাসের মাঝামাঝিতে সয়াবিন বীজ বপন করেন। আর পৌষের শুরুতেই ওই বীজ বিক্রির উপযোগী হয়। কৃষক নিজেদের উৎপাদিত বীজ দিয়েই আবার নতুন আবাদ শুরু করেন। তারা জানান, প্রতি দেড় শতক জমিতে বীজ সয়াবিন আবাদ হয় ২০ কেজি। আর মৌসুমে এক একর জমিতে সয়াবিন উৎপাদন হয় ৪০ মণ। কাঁচা বীজ সয়াবিন প্রতি মণ বিক্রি হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা।
আর মৌসুমে সয়াবিন বিক্রি হয় প্রতি মণ এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রায়পুর উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের মেঘনার নদীর চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর, চর ইন্দুরিয়া এবং সদর উপজেলার মেঘার চরে ৩-৪ বছর ধরে অসময়ে (বর্ষাকালে) সয়াবিন চাষ করছেন কৃষকরা। প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে এ সয়াবিন চাষ হচ্ছে। প্রচলিত সয়াবিনের তুলনায় এর দামও বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রায়পুর উপজেলার চরকাচিয়া পানির ঘাট এলাকার সয়াবিন বীজ ব্যবসায়ী স্বপন গাইন জানান, চরকাচিয়া পানির ঘাট ও মোল্লারহাটে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বীজ সয়াবিনের হাট বসে। চরকাচিয়া, কানিবগার চর, টুনুর চর, খাসিয়ার চর ও চরইন্দুরিয়ায় উৎপাদিত সয়াবিন এসব বাজারে আসে। প্রতি হাটে গড়ে প্রায় ৫০০ থেকে এক হাজার টন সয়াবিন বিক্রি হয়। ওই বাজারের বীজ নিয়ে হায়দারগঞ্জ, হাজীমারাসহ উপজেলার আরও পাঁচটি বাজারে বিক্রি হয়। লক্ষীপুর ছাড়াও
নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা সয়াবিন বীজ কেনেন।
চরকাচিয়া ও টুনুর চরে গিয়ে দেখা যায়, চরাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে বীজ সয়াবিনের আবাদ করা হয়েছে। কৃষক-কিষানি গাছ থেকে পাকা সয়াবিন মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মাড়াই করা সয়াবিন আবাদের জন্য চাহিদা অনুসারে বীজ রেখে বাকি অংশ নৌকায় করে ঘাটে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষক। সেখানে আড়তদার ও পাইকারি বীজ বিক্রেতারা তা সংগ্রহ করে সয়াবিন বীজের প্যাকেট করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন অন্যত্র।
মোল্লারহাট বাজার এবং পানিরঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো শুকনো বীজ কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর কাঁচা নতুন বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২১০ টাকায়। কানিবগার চরের সয়াবিন চাষি ইসমাইল ব্যাপারী বলেন, ‘আগের বছরের শুকনো বীজের তুলনায় নতুন কাঁচা উৎপাদিত বীজ শতভাগ গজায়। সে কারণে দ্বিগুণ দামেও কৃষক কাঁচা সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করেন।
চরকাচিয়ায় ২০ একর জমিতে সয়াবিন আবাদ করেছেন শাহজাহান মোল্লা। তিনি জানান, দুই বছর আগেও স্থানীয় কৃষক ও বিএডিসি থেকে সয়াবিন বীজ সংগ্রহ করতেন। গত বছর তিনি স্থানীয় এক কৃষকের পরামর্শে কাঁচা বীজ সয়াবিন জমিতে বপন করেন, ফলনও হয় ভালো। এ মৌসুমে ২০ একর জমিতে আগাম বীজ সয়াবিন আবাদ করে প্রতি একরে তিনি ১২ মণ করে বীজ সয়াবিন পেয়েছেন।
একই এলাকার সয়াবিন চাষি নুর নবী হাওলাদার জানান, দুই একর জমিতে তিনি আগাম সয়াবিন আবাদ করেছেন। কাঁচা সয়াবিন কেজি ২০০ টাকা দরে ৪০০ কেজি সয়াবিন বিক্রি করেছেন তিনি। তবে এ বছর চরে কয়েক দফা জলোচ্ছ¡াসের কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তবুও তিনি ২৫ মণ সয়াবিন পেয়েছেন এবং দাম ভালো পাওয়ায় মুনাফা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার বীজ ব্যবসায়ী মহিন হোসেন বলেন, প্রতি টন বীজ সয়াবিন এক লাখ ৯০ হাজার টাকা দরে চার টন সয়াবিন ক্রয় করেছেন তিনি। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তিনি কেজিতে পাঁচ টাকা লাভে বিক্রি করছেন।
কয়েকজন সয়াবিন চাষি জানান, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস সয়াবিন চাষের প্রধান মৌসুম। এ সময়েই চরের বালুময় মাটি থেকে বীজ সয়াবিন ঘরে তোলেন কৃষক। সে সয়াবিন সপ্তাহখানেক পর আবার মাটিতে বপন করেন কৃষক।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসির) ল²ীপুরের সিনিয়র পরিচালক শরীফ উল্লাহ জানান, গত বছরে সয়াবিন চাষিদের মাঝে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টন বীজ বিক্রয় করেছিল বিএডিসি। কিন্তু এবার মাত্র পাঁচ টন চাহিদা পাওয়ার কথা জানালেন তিনি। বিএডিসির বীজ ১০০ টাকার নিচে বিক্রয় হলেও কৃষক তা কিনছে না বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অন্তত ৩৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় তিন থেকে চার লাখ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হয়। এসব জমি থেকে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হয়, যার শতকরা ৬০ ভাগ সয়াবিন উৎপাদিত হয় লক্ষীপুরে। সয়াবিন উৎপাদনের প্রধান সমস্যা ছিল বীজ। এবার চরে উৎপাদিত সয়াবিন বীজ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে।’
লক্ষীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বেলাল হোসেন খান জানান, এ বছর লক্ষীপুর জেলায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হবে। সেখানে দুই হাজার ৭৩০ টন বীজ লাগবে। চরে উৎপাদিত বীজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায়ও বিক্রি হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম দেশ। আর বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রধান জেলা লক্ষীপুর। সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকার কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উপক‚লীয় জেলা লক্ষীপুরের ব্র্যান্ডিং নাম রাখে সয়াল্যান্ড।