মেঘনা ব্যাংক ১৭ শতাংশ সুদ নিচ্ছে

রোহান রাজিব: সুদহার নির্ধারণের সব ধরনের কলাকৌশল তুলে দিয়ে গত মাসে তা ‘বাজারভিত্তিক’ করে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষণার পর অনেক ব্যাংকই আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়িয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাংকের সুদহার ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে বেসরকারি খাতের মেঘনা ব্যাংকের। ব্যাংকটি মে মাসে বিভিন্ন খাতের ঋণে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, হঠাৎ সুদহার বৃদ্ধিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। ব্যবসা করে যে রিটার্ন আসবে, তাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাবে না। আর ১৭ শতাংশ সুদহার নেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সবাইকে বাস্তবতা বুঝে সুদহার বাড়াতে হবে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মাসজুড়ে বিভিন্ন খাতে অর্থায়নে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করেছে মেঘনা ব্যাংক। ব্যাংকটি এসএমই, বড় শিল্প, শিল্পের চলতি মূলধন, রপ্তানি ও বাণিজ্য অর্থায়নে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করে। সুদহার বাজারের ওপর ছাড়ার আগে এপ্রিলজুড়ে ব্যাংকটি বড় শিল্পে গড়ে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েছিল। সব খাত মিলে সার্বিক ঋণের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আহসান খলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে যাচ্ছেন বলে জানান। পরে কখন কল দেবÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে হেড অব করপোরেট যোগাযোগ করবে। তবে কেউ যোগাযোগ করেননি।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং বড় শিল্পের চলতি মূলধন ঋণে মে মাসে সুদারোপ করেছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। আর ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণে করেছে সোয়া ১৪ শতাংশ থেকে সোয়া ১৫ শতাংশ। আগের মাসে ব্যাংকটির সব খাতে গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পের মেয়াদি ও চলতি বিনিয়োগে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক সুদারোপ করেছে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ। আগের মাসে ব্যাংকটির সব খাতে বিনিয়োগে গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্প এবং চলতি মূলধন ঋণে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক সুদারোপ করেছে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। আগের মাসে সব খাতে ব্যাংকটি গড়ে সুদারোপ করেছিল ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ। যমুনা ব্যাংক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পের চলতি মূলধন ঋণে সুদারোপ করেছে সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ। আগের মাসে সব খাতে ব্যাংকটির গড় সুদের হার ছিল ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ।

সিটিজেনস ব্যাংক ক্ষুদ্র শিল্পের মেয়াদি ঋণে ১৫ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করেছে। আর মাঝারি ও বড় শিল্প এবং চলতি মূলধন ঋণে সুদারোপ করেছে ১৪ শতাংশ। আগের মাসে সব খাতে ব্যাংকটির গড় সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওয়ান ব্যাংক ক্ষুদ্র শিল্পের চলতি মূলধন ঋণে সুদারোপ করেছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। ঢাকা ব্যাংক ক্ষুদ্র শিল্পের মেয়াদি ঋণে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করেছে। আর মাঝারি ও বড় শিল্প এবং চলতি মূলধন ঋণে একই সুদারোপ করেছে। এর বাইরে অন্য ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে সুদারোপ করেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. এমরানুল হক বলেন, এভাবে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করলে ব্যবসার ক্ষতি হবে। নতুন করে কেউ ব্যবসায় আসবে না। ব্যবসা করে যে রির্টান আসবে, এতে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। সবাইকে বাস্তববাদী হতে হবে। এখন ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে যাওয়া উচিত নয়। কারণ এখনও এমন কিছু হয়ে যায়নি যে ১৭ শতাংশ নিতে হবে। আমরা এটা আরও কমাব।

সুদহারের এমন লাগামহীন বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ খাতসংশ্লিষ্টরা। কারণ এর ফলে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। আর উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যমূল্যও বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরিবর্তে উল্টো আরও বাড়তে পারে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মুদ্রানীতি আরও সংকোচনমুখী করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায় ঋণের সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে কয়েক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আইএমএফের পরামর্শে গত মে মাসের শুরুতে সব ধরনের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাজারে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঘোষণার পরই সুদহার বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের তহবিল সংগ্রহের খরচ বেশি, সেসব ব্যাংক ঋণ বিতরণে বেশি সুদারোপ করছে। এতে সার্বিক ব্যাংক খাতে ঋণের গড় সুদহার বেড়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল। তবে গত বছরের জুলাই থেকে সেই সীমা তুলে দিয়ে সুদহার নির্ধারণের স্মার্ট পদ্ধতি (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় হার) চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে প্রতি মাসেই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। সর্বশেষ এপ্রিলে সেটি বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে আইএমএফের পরামর্শে গত মাসে সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর থেকে সুদের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে আসছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকরা। এরই মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করে ঋণের সুদহারের জন্য সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ওই বৈঠকে এফবিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুদহার বাজারভিত্তিক করার ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের সুযোগ পেয়েছে। ফলে সব ধরনের ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সুদের হার বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাবে এবং স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর সেদিন ব্যবসায়ীদের জানিয়েছিলেন, বর্তমান তহবিল খরচ বিবেচনায় সুদের হার ১৪ শতাংশের নিচে থাকবে বলে তিনি আশা করেন। কিন্তু ওই মাসেই ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে সুদের হার।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০