শীতের মিষ্টি সকাল যেন সোনাঝরা রোদ কুয়াশার মধ্য দিয়ে আলতো পরশ বুলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। শীত একা কখনও আসে না, সঙ্গে কিছু মেহমানও নিয়ে আসে। এদের মধ্যে অতিথি পাখি অন্যতম। তাদের উড়ে বেড়ানো শীতকালকে অনেক বেশি মনোমুগ্ধ করে তোলে। দিনভর তাদের মনোরম আড্ডায় এদেশের হাওর-বাঁওড়গুলো যেন বিরল আনন্দে মেতে উঠে। আর রাতের আঁধারে শিশিরের সঙ্গে ঘাস ও গুল্মলতার এক ধরনের মিতালি গড়ে উঠে এ শীতকালে। ঠিক এমন সময় আমরা চারবন্ধু পরিকল্পনা করি পাহাড়ের রাজকন্যা ভারতের দার্জিলিংয়ে শীত উপভোগ করতে যাওয়ার। পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে শীতের এক রাতে আমরা দেশ ছাড়ি দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে।
ভিসায় সড়ক ও আকাশপথ উল্লেখ করেছিলাম। আমরা সড়কপথে রওনা দিই সেই রাতে। সকালে পৌঁছে যাই বেনাপোল স্থলবন্দরে। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতে প্রবেশ করি। বলে রাখা ভালো, ইমিগ্রেশনের কাজ নিজে করা ভালো।
ভারতে প্রবেশের পর প্রথমে ডলার ভেঙে রুপি করে নিই। এরপর পেট্রোপোল থেকে ট্যাক্সিতে বনগাঁও রেলস্টেশনে যাই। ভারতে ট্রেন ভ্রমণ ভীষণ জনপ্রিয়। খরচ বেশ কম। ঘণ্টা দেড়েক ট্রেনে বসে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ দেখতে দেখতে শিয়ালদহ চলে যাই। পরিবেশটা আলাদা হলেও ভাষার কারণে মানুষগুলোকে দূরের মনে হয়নি। যে কোনো জিজ্ঞাসায় তাদের উত্তর ছিল নমনীয়। আমার দেখা সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন শিয়ালদহ। যতদূরে চোখ যায়, পুরোটা জুড়েই রেলস্টেশন। হাজার হাজার মানুষ যেন ছুটছে আর ছুটছে। দেখতে থাকি তাদের ব্যস্ততা। সেখানে বিকালের হালকা খাবার খেয়ে নিউ জলপাইগুড়ির টিকিট কাটি।
নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে আমাদের ট্রেন যাত্রা শুরু করে আটটায়। ট্রেনে দার্জিলিংয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই শুনতে পাই তার সৌন্দর্যের নানা উপমা। পরেরদিন সকাল নয়টায় নামি শিলিগুড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেলস্টেশনে। জানুয়ারির শীতের তীব্রতা হাড়ে হাড়ে টের পাই তখন। একই সঙ্গে দালালদের টানা-হেঁচড়া শুরু হয়। তাদের পাশ কাটিয়ে একজন শুভাকাক্সক্ষীর পরামর্শ নিয়ে দার্জিলিংয়ের মেল-এ যেতে ট্যাক্সি ভাড়া করি। দার্জিলিং যেতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। এ পথটুকুতে কখনও আমরা ঘন মেঘের শুভ্রতায় হারিয়ে গিয়েছি। কখনওবা এক চিলতে রোদ মেঘের কাছ থেকে লুকিয়ে পাহাড়কে আলোকিত করা দেখছি। প্রকৃতির বিচিত্র খেলা উপভোগ করি তখন। স্বপ্নের মতো কেটেছে যাত্রা পথটুকু। এত কাছ থেকে আগে কখনও মেঘ দেখিনি। পাহাড় মেঘ আর সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের মাঝে মাঝে ছোটখাটো অনেক লেক চোখে পড়েছে। লেকের পানি আয়নার মতো স্বচ্ছ। আর ওই পানিতে গাছের ছায়া অদ্ভুত সুন্দর মায়ার জগৎ তৈরি করে রেখেছিল।
দার্জিলিংয়ে তখন বেলা গড়িয়ে বিকাল ছুঁই ছুঁই। প্রথমে হোটেল ভাড়া করি।
এ শহরের মানুষের প্রধান ভাষা নেপালি হলেও বাংলা ও হিন্দির বেশ চল রয়েছে। বছরজুড়ে অনেক বিদেশি পর্যটক আগমনের কারণে ইংরেজি ভাষাও খুব প্রচলিত।
দর্শনীয় স্থান
দার্জিলিং কেব্ল কার: এ কেব্ল কার দেখার জন্য তেঞ্জিং রক পাড়ি দিতে হয়। মেল থেকে তেঞ্জিং রকে যাওয়ার জন্য আলাদা গাড়ি ভাড়া করতে হয়। কেব্ল কারে ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি ২০০ রুপি খরচ করি। এই কারে ঘোরার মজাই আলাদা। মনে হয়, শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। কমপক্ষে ১৫ মিনিট পর আমরা এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে যাই।
জাপানিজ টেম্পল ও পেস প্যাগোডা: এ মন্দিরটি শহরের খুব কাছে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে সেখানে যেতে। এক জাপানি সাধুর অর্থায়নে মন্দিরটি নির্মাণ হয়েছিল। এ মন্দিরের দরজায় দুটি সিংহমূর্তি আছে। আর একেবারে ডান দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যায় পেস প্যাগোডা।
রক গার্ডেন: শহরের বেশ নিচে এর অবস্থান। এখানে যাওয়ার পথে অনেক চা বাগান চোখে পড়ে। নামে পাথুরে গন্ধ থাকলেও প্রকৃত পক্ষে রক গার্ডেন একটা ঝর্ণা। বেশ কিছু জায়গা নিয়ে একটা বাগানও আছে। ওই ঝর্ণার চারপাশ খুব সুন্দর ছিল। ঝর্ণার ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় পাহাড়, আকাশ অপূর্ব লাগছিল।
অবজারভেটরি হিল ও মহাকাল টেম্পল: চৌরাস্তার অনেক ওপরে অবস্থিত অবজারভেটরি হিল ও মহাকাল টেম্পল। আশপাশে অনেক গাছ থাকায় প্রথমে বুঝতে অসুবিধায় পড়েছিলাম। অবজারভেটরি হিলের পাশেই রয়েছে মহাকাল মন্দির।
চার-পাঁচদিন ঘোরাঘুরি করে দার্জিলিংয়ের প্রায় সবকিছু দেখে ফেলি। উপভোগ করি দার্জিলিংয়ের চা। ভ্রমণে যেন পূর্ণতা এনে দিয়েছিল সেই চা। পঞ্চম দিন খুব সকালে নাশতা সেরে ফিরে আসার পথ ধরি রওনা দিই শিলিগুড়ির দিকে। দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি এয়ারপোর্ট যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। শিলিগুড়ি থেকে কানেক্টিং ফ্লাইটে কলকাতা। সেখান থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসি।
Add Comment