বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন রাঙামাটির সাজেক। ঘুরে এসে অপরূপ জায়গাটির বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. ইমরান হোসেন
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন জীবন। নিজের শহর ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে লেখাপড়া। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। কলেজ জীবনের বন্ধুদের ছেড়ে নতুন বন্ধু বেছে নিই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। দেখতে দেখতে চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও প্রায় শেষের পথে। বন্ধুদের কেউ হয়তো ব্যবসা কিংবা চাকরিতে যোগ দেবে। কেউবা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যাবে। ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা হলেও বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। মনে রাখার মতো তেমন কোনো স্মৃতিও নেই। তাই অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই ঠিক করলাম বাংলার ‘দার্জিলিং’খ্যাত সাজেকে বেড়াতে যাব। অনেক গল্প শুনেছি এর; এবার যাওয়ার পালা।
পরিকল্পনামাফিক আগে থেকে টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। ২৫ অক্টোবর রাতে সাজেকের উদ্দেশে রওনা হই। রাকিবুল হাসান রেজা, জাবেদ হোসেন শীতল, বনি আমিন রাফি, পারভেজ আবেদীন জিকু সময়মতো বাস কাউন্টারে চলে আসে সেদিন। একটা কথা বলে রাখা ভালো রাকিবুল ছাড়া আমাদের কোনো ভ্রমণই যেন জমে না। রাত ১০.৪৫ ছাড়ার কথা থাকলেও বাস ছাড়ল ১১টায়। বাস চলছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঢাকা ত্যাগ করি আমরা। মেঘনা ব্রিজের কাছে যেতেই জ্যামে পড়লাম। ৩০ মিনিট পর জ্যাম ছেড়ে গাড়ি আবারও তার পুরোনো গতিতে ফিরে গেল। আমাদের গাড়িটা তুলনামূলক দ্রুতগতিতে চলছিল সেদিন।
সমুদ্রের গর্জন শুনেছি; কিন্তু পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য আগে কখনও দেখা হয়নি। পাহাড়ের প্রতি যে ভালোবাসা, তা হয়তো নিজের মধ্যেই অজানা। তাই অজানাকে জানার ইচ্ছাটাই নিজের মধ্যে বেশি কাজ করছিল। সকাল ৭টার মধ্যে আমরা খাগড়াছড়ি পৌঁছালাম। এখান থেকেও চাঁদের গাড়ি পাওয়া যায়, যা সাজেকের প্রধান যান। তাছাড়া মোটরসাইকেল বা সিএনজি অটোরিকশায়ও যাওয়া যায়। আমরা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে গেলাম দীঘিনালা।
ভ্রমণের পর সবাই ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা সেরে ফেলি। এরপর রওনা দিই সাজেকের উদ্দেশে। আমরা পাঁচজন। চাঁদের গাড়িতে খরচ একটু বেশি। অন্যদিকে অটোরিকশায় তিনজনের বেশি যাওয়া যায় না। মোটরসাইকেলেও ঝুঁকি বেশি। তাই অন্য কোনো দলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পেয়েও গেলাম দুই পর্যটককে রনি খান ও লোকমান খান। কিছু মানুষ খুব সহজেই আপন হয়ে যায় রনি ও লোকমান ভাই তেমনই দুজন। সবাই চাঁদের গাড়িতে উঠে পড়ি। এখন আমরা সাতজন। গাড়ি চলছে, চারদিকে ছোট-বড় হাজারো পাহাড়ের সমষ্টি। কোনোটা অনেক উঁচু; আবার কোনোটা নিচু। পাহাড়ের গা ঘেঁষে স্থানীয়রা বাড়ি করেছেন। এখানকার অধিকাংশ বাড়ি কাঠের তৈরি।
আমরা হাজাছড়া ঝরনার কাছে পৌঁছালাম। মেইন রোড থেকে ঝরনা একটু দূরে। প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে ঝরনায় পৌঁছাই। উঁচু পাহাড় আর পাথরখণ্ড ভেদ করে পানি নিচে পড়ছে। ঝরনা যেন পাহাড়ের সঙ্গী। ঝরনার পানিতে গোসলের লোভ সামলাতে পারছিলাম না। তবু না ভিজে সেদিন আবারও গাড়িতে উঠে পড়ি।
চারদিকে কুয়াশা যেন পাহাড়কে ঢেকে রেখেছিল। শীতের কাপড় কারো সঙ্গেই নেই। কুয়াশার পাশাপাশি বাতাস। শীত যেন আমাদের তাড়া করছিল। অনুমতি নিয়ে যেতে হয় সাজেকে।
বিশাল আকাশের নিচে বনভূমির সন্ধান পেতে সাজেক ভ্যালির বিকল্প চিন্তা করা যায় না। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন স্থানীয়রা।
ভারত থেকে আসা মাচালং নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে মাচালং বাজার। এ এলাকা সাজেক ইউনিয়নের প্রধান কেন্দ্রস্থল। সপ্তাহে দুদিন বৃহস্পতি ও শুক্রবার এখানে বাজার বসে। জুমের ফসল বিক্রি করার আদর্শ স্থান এটি।
আকাশচুম্বী পাহাড়ের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। দীর্ঘজীবী আর বড় বড় বৃক্ষের দেখা মেলে এ পথে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিচ্ছিন্ন বসতি। দুর্গম পাহাড়ে মেঘের গড়াগড়ি দেখতে না দেখতেই আমরা পৌঁছে যাই সেই মেঘের দেশে। উঁচু নিচু পিচযুক্ত পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা শেষ হয়। পা রাখি রুইলুইপাড়ায়। এটা সাজেক উপত্যকার মূল কেন্দ্র।
রুইলুইপাড়ায় লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বাস। পাড়ার সবগুলো বাড়ির রং লাল-সবুজ। আমরা এখানে আগে থেকেই হোটেল বুকিং করে রেখেছি। হোটেলগুলোর বেশিরভাগই কাঠের।
দেশি মুরগি, ডাল, সবজি দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে কংলাক পাহাড়ের দিকে রওনা হই। রুইলুইপাড়া থেকে অনেক সময় হাঁটার পর কংলাকপাড়া। পাংখোয়াদের বসবাস এখানে। বিশাল পাথরখণ্ডের পাদদেশেই কংলাকপাড়ার অবস্থান। এটাকে আবার কেউ কেউ ‘কংলাক পাহাড়’ও বলেন। কংলাকের পাথরচ‚ড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকা দেখা যায়। সাজেকের প্রধান আকর্ষণ এই কংলাক পাহাড়। এখানে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে যেন আকাশ ঘুমায়। পাহাড় আর আকাশের ভালোবাসার বন্ধন দেখা যায় এখান থেকে। দিনের শেষে কংলাকপাড়া থেকে রওনা হলাম হেলিপ্যাডের উদ্দেশে।
চাঁদের আলোয় আলোকিত হেলিপ্যাড। অসংখ্য নক্ষত্রে ঢাকা সাজেকের বিস্তৃত আকাশ। নিচে আমরা ধবধবে জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত। সে আলোয় বাদ পড়েনি উপত্যকাও। আলোর কারণে কাছে-দূরের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠছে ঘন সাদা কুয়াশা। এত ঘন যে, কুয়াশাকে মনে হয় মেঘের ভেলা। বিভ্রম জাগে, এ কী আমাদের চেনা কোনো জগত! রাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পর খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমাতে গেলাম।
ভোর ৬টার পর ঘুম ভাঙে। বেরিয়ে পড়ি মেঘ দেখার উদ্দেশ্যে। হেলিপ্যাডের ওপর দাঁড়িয়ে দেখি মেঘের রাজ্য। মনে হচ্ছিল, মেঘের খুব কাছে চলে এসেছি। মাঝেমধ্যে মেঘ পায়ের কাছে যেন লুটোপুটি খাচ্ছে। আমাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছিল মেঘের দল। দূরের নদী, সবুজ বন, গেরুয়া পাহাড় সবটুকু অদৃশ্য হয় সাদা মেঘের আড়ালে। আসলে এগুলো মেঘ নয়। মেঘের রূপ নিয়েছে কুয়াশা। তবে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় মেঘের বসতবাড়ি এখানে। একটু নিচে নামলে মনে হয় মেঘ মাথার ওপরে। মেঘ কেটে কেটে ফিরলাম হোটেলে।
সকালের খাবার শেষ করলাম এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বাম্বু চিকেন দিয়ে। বাঁশের মধ্যে মুরগির মাংস দিয়ে এ খাবার তৈরি হয়। সেই স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে।
এরপর ফেরার পালা। কিন্তু ফিরতে মন চায় না। তবুও গাড়িতে উঠে বসলাম। উঁচু পাহাড় থেকে গাড়ি নিচের দিকে নামছে। পাশের পাহাড় আর বড় বড় বৃক্ষ আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল যেন। স্থানীয় শিশুরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত উঁচিয়ে আমাদের বিদায় দিয়েছিল সেদিন।
যেভাবে যাবেন যেখানে থাকবেন
সাজেক উপত্যকায় যেতে হয় খাগড়াছড়ি শহর হয়ে। জায়গাটির অবস্থান রাঙামাটিতে হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি শহর দিয়ে।
রাজধানী থেকে শ্যামলী, হানিফসহ বেশকিছু পরিবহনের বাসে চড়ে খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। ভাড়া নেবে ৫২০ টাকা। শান্তি পরিবহনের বাস দীঘিনালা যায়। ভাড়া ৫৮০ টাকা। এছাড়া বিআরটিসি ও সেন্টমার্টিন্স পরিবহনের এসি বাস খাগড়াছড়ি যায়। যোগাযোগ সেন্টমার্টিন্স
পরিবহন-আরামবাগ, ০১৭৬২৬৯১৩৪১, ০১৭৬২৬৯১৩৪০। শ্যামলী পরিবহন- আরামবাগ, ০২-৭১৯৪২৯১। কল্যাণপুর, ৯০০৩৩৩১, ৮০৩৪২৭৫। আসাদ গেট, ৮১২৪৮৮১, ৯১২৪৫৪। শান্তি পরিবহন- আরামবাগ, ০১১৯০৯৯৪০০৭। চট্টগ্রাম থেকেও খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। বিআরটিসি এসি বাস কদমতলী (চট্টগ্রাম), ০১৬৮২৩৮৫১২৫।
খাগড়ছড়ি গিয়ে চাঁদের গাড়ি কিংবা মোটরবাইক অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে যেতে পারবেন সাজেকে। চাঁদের গাড়ির ভাড়া প্রায় ৫ হাজার টাকা। তবে আপনি দীঘিনালা হয়ে গেলে তুলনামূলক কম খরচে যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন? চিন্তার কারণ নেই। পর্যটন মৌসুমে রাজধানী থেকে ওখানকার হোটেলগুলো বুকিং করে যেতে হয়। না হলে উন্নতমানের হোটেল নাও পেতে পারেন।
কয়েকটি হোটেল
মেঘ মাচাং: সাজেকের বেস্ট রিসোর্টের মধ্যে একটি মেঘ মাচাং। পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য এখান থেকে ভালোভাবে দেখা যায়। যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮২২১৬৮৮৭৭ নম্বরে। রুমপ্রতি ২৫০০ টাকা খরচ করতে হবে। এক রুমে চারজন থাকতে পারবেন।
মেঘ পুঞ্জি: সাজেকের আরও একটি সেরা রিসোর্টের মধ্যে অন্যতম। যোগাযোগের জন্য ডায়াল করুন ০১৮১৫৭৬১০৬৫ (ঢাকা), ০১৯১১৭২২০০৭ (সাজেক) এ নম্বরগুলোয়।
জুমঘর: ০১৮৮৪২০৮০৬০ নম্বরে ফোন দিয়ে বুকিং করতে পারবেন।
রক প্যারাডাইস: সাজেকের কংলাক পাড়ায় অবস্থিত এ কটেজটি আপনাকে বেস্ট ভিউ দেবে। বুকিং করতে ফোন করতে পারেন ০১৮৪২৩৮০২৩৪ নম্বরে।
সাজেক রিসোর্ট: মন ভোলানো চমৎকার একটি রিসোর্ট। থাকার জন্য দারুণ।
রুন্ময়: এটি সাজেকে অবস্থিত। এর নিচতলায় তিনটি কক্ষ আছে। প্রতিটির ভাড়া ৪ হাজার ৪৫০ টাকা। একটি কক্ষে দুজন থাকতে পারবেন। ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নিতে পারবেন। ওপরের তলায় দুটি কক্ষ আছে, ভাড়া ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। প্রতিটি কক্ষে দুজন থাকতে পারবেন। এখানেও ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নিতে পারবেন। চারটি তাঁবু আছে। প্রতি তাঁবুতে ২ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে চারজন থাকতে পারবেন। যোগাযোগ: ০১৮৬২০১১৮৫২।
আলো রিসোর্ট: এটি সাজেক যাওয়ার আগে রুইলুইপাড়ায় অবস্থিত। এটিতে মোট ছয়টি রুম আছে। ডাবল রুম চারটি (দুটি করে খাট)। প্রতিটির ভাড়া হাজার টাকা। সিঙ্গেল রুম দুটি। প্রতিটির ভাড়া ৭০০ টাকা। যোগাযোগ: পলাশ চাকমা- ০১৮৬৩৬০৬৯০৬।
রুইলুইপাড়া ক্লাবহাউজ: এটিও রুইলুইপাড়ায় অবস্থিত। এখানে ১৫ জনের মতো থাকতে পারবেন। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। রান্না করে খেতে পারবেন। এর কেয়ারটেকার মইয়া লুসাই। লক্ষণ নামেও একজন আছে। যোগাযোগ: মইয়া লুসাই ও লক্ষণ।