Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 10:38 am

মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ এখনও বাকি ৪৮ শতাংশ

ইসমাইল আলী: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে (২০২১ সালের ডিসেম্বরে) দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এজন্য উত্তরা-মতিঝিল রুটে নির্মাণাধীন এ মেট্রোরেল প্রকল্পের ৮টি প্যাকেজের বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। তবে করোনার ধাক্কায় গতি হারিয়ে ফেলেছে এ প্রকল্প। এতে গত সাত মাসে (এপ্রিল-অক্টোবর) মাত্র ৮ দশমিক ১২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে প্রকল্পটির। অর্থাৎ সাত মাসে গড়ে এক দশমিক ১৬ শতাংশ করে অগ্রগতি হয়েছে।

ফাস্ট ট্র্যাক কমিটিতে পাঠানো প্রকল্পটির সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের আট প্যাকেজের মধ্যে শুধু প্রথমটির কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর অগ্রগতি অনেক ধীর। ফলে অক্টোবর শেষে মেট্রোরেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ এখনও প্রায় ৪৮ শতাংশ কাজ বাকি রয়ে গেছে।

কবে নাগাদ বাকি কাজ শেষ হবে তা নিশ্চিত নন কেউ। ফলে মেট্রোরেলের উদ্বোধনও পিছিয়ে যাবে। ফাস্ট ট্র্যাক কমিটিতে পাঠানো প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনার কারণে মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে নিয়োজিত ঠিকাদার ও পরামর্শকদের একটি অংশ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। পরে তারা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন না করায় নির্মাণকাজ প্রত্যাশিত মাত্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে জাপানের জনবল প্রত্যাবর্তন শুরু করেছে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২৭২ জন কর্মী কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে। তবে কারও মৃত্যু হয়নি।

এদিকে প্রকল্পটির নিয়োজিত জনবলের কভিড-১৯ প্রতিরোধে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চলমান আছে। এজন্য গাবতলী কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১০ শয্যা ও উত্তরার পঞ্চবটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৪ শয্যাবিশিষ্ট দুটি আইসোলেশন সেন্টার (ফিল্ড হাসপাতাল) চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রকল্পে নিয়োজিত জনবল কাজ করছে।

প্রকল্পটির তথ্যমতে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্পের ১নং প্যাকেজের (সিপি-০১) আওতায় রয়েছে উত্তরায় ডিপোর ভূমি উন্নয়ন। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে এ প্যাকেজের চুক্তি সই করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এ প্যাকেজের কাজ সম্পন্ন হয়। আর ২নং প্যাকেজের (সিপি-০২) আওতায় ডিপোর পূর্ত কাজ চলছে। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ প্যাকেজের চুক্তি সই হয়। অক্টোবর পর্যন্ত এ অংশের অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। যদিও গত বছর জুনের মধ্যে এ অংশের নির্মাণ করার কথা ছিল।

প্রকল্পটির ৩ ও ৪নং (সিপি-০৩ ও ০৪) প্যাকেজের আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট এ প্যাকেজের কাজ শুরু হয়। অক্টোবর পর্যন্ত এ প্যাকেজের অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। সিপি-০২, সিপি-০৩ ও সিপি-০৪ বাস্তবায়ন করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। তবে সিপি-০২-এ ইটাল থাইয়ের সহযোগী হিসেবে আছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন।

এদিকে মেট্রোরেলের ৫নং প্যাকেজের (সিপি-০৫) আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রায় ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এবং বিজয় সরণি, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকায় তিনটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ অংশের কাজ যৌথভাবে করছে জাপানের টেকেন করপোরেশন, অ্যাবে নিক্কো ও বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। অক্টোবর পর্যন্ত এ অংশের অগ্রগতি ৫০ দশমিক ১৮ শতাংশ।

মেট্রোরেলের ৬নং প্যাকেজের (সিপি-০৬) আওতায় কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হবে। এছাড়া শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিলে চারটি মেট্রো স্টেশনও নির্মাণ করা হবে। এ অংশের কাজ যৌথভাবে করছে জাপানের সুমিতোমা মিতসুই কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। অক্টোবর পর্যন্ত এ অংশের অগ্রগতি ৫১ দশমিক ১২ শতাংশ।

এদিকে ৭নং প্যাকেজের আওতায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো ওঠানামার জন্য চলন্ত সিঁড়ি ও লিফট, প্রায় ২০ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক, স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থাপনা, ১৩২ কেভি বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম, প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর ইত্যাদি স্থাপন করা হবে। এর কাজ করছে জাপানের মারুবিনি করপোরেশন ও ভারতের এলঅ্যান্ডটি (লারসন অ্যান্ড তুবরো)।

২০১৮ সালের ১১ জুলাই প্যাকেজটির কাজ শুরু হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত এ অংশের অগ্রগতি ৫১ শতাংশ। প্যাকেজের আওতায় থাকা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে। তবে করোনার কারণে এগুলোর শিপমেন্ট বিলম্বিত হচ্ছে। তাই কবে নাগাদ তা দেশে এসে পৌঁছাবে তা নিশ্চিত নয়। দেশে আসার পর এসব অংশ স্থাপন শুরু করা হবে।

সর্বশেষ ৮নং প্যাকেজের (সিপি-০৮) আওতায় মেট্রোরেলের জন্য রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করছে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। এর মধ্যে ২৪ সেট ট্রেন এবং ডিপো ইকুইপমেন্ট ছাড়াও ট্রেন সিমুলেটর, খুচরা যন্ত্রাংশ ও সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ প্যাকেজের বাস্তব কাজ শুরু হয়। অক্টোবর পর্যন্ত এ অংশের অগগ্রতি ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

জানতে চাইলে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক সম্প্রতি শেয়ার বিজকে বলেন, করোনার কারণে ৩৪টি দেশে জাপানি নাগরিকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে সম্প্রতি কিছুটা জনবল আসতে শুরু করেছে। এছাড়া বিকল্প ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকল্প এলাকার কাজ জাপানে বসে মনিটরিং করবে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে করোনার কারণে আগের মতো পরিবেশে কাজ করা যাবে না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করছেন বাকিরা।

তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পে মাত্র দুটি (পঞ্চম ও ষষ্ঠ) প্যাকেজের ঠিকাদার হিসেবে আছে জাপানি কোম্পানি। বাকি অংশে আছে থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের ঠিকাদার। ওই তিন দেশ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে আনা হয়েছে। ওই অংশগুলোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। বাকি দুই প্যাকেজের জন্য জাপানি ঠিকাদারদের প্রয়োজনীয় জনবল বাংলাদেশে আসার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। তবে বাস্তবায়ন বিলম্বে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।