মেট্রোরেল নিয়ে আবারও টানাটানি রেলওয়ের!

ইসমাইল আলী: রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল (এমআরটি বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) লাইন-৬। এছাড়া এমআরটি লাইন-১ ও লাইন-৫-এর উত্তর অংশের নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। আগামী বছর এ দুটি মেট্রোরেলেরও নির্মাণকাজ শুরুর কথা রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে।

মেট্রোরেলের পরিচালনার দায়িত্বও এ কোম্পানির ওপরই। এরই মধ্যে দুই দফা মেট্রোরেলের ট্রায়াল রান সম্পন্ন করেছে ডিএমটিসিএল। আগামী বছর ডিসেম্বরে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে মাঝপথে এসে হঠাৎই মেট্রোরেল নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব চাইছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটি।

এর আগে ২০১২ সালে একবার মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল রেলওয়ে। তবে রেলওয়ের সে প্রস্তাবে আপত্তি তোলে মেট্রোরেল নির্মাণে অর্থায়নকারী দাতা সংস্থা জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। লোকসানি সংস্থা রেলওয়েকে মেট্রোরেল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার বিরোধিতা করে জাইকা। প্রয়োজনে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দেয় সংস্থাটি। এতে বাধ্য হয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনা থেকে পিছিয়ে আসে রেলওয়ে। তবে নতুন করে মেট্রোরেল পরিচালনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে রেলওয়ে। এতে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে ঢাকায় অসংখ্য আবাসন, বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠলেও প্রয়োজন অনুযায়ী সড়ক অবকাঠামো বা গণযোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রবল যানজট ঢাকার নাগরিকদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তোলে। নগরীর প্রতিটি সড়কে প্রচণ্ড যানজটে প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। এ অবস্থায় প্রায় দুই কোটি নাগরিকের নগরী রাজধানী ঢাকার স্থবির গণযোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি সঞ্চারে বাস্তবায়ন করা হয়েছে একাধিক প্রকল্প। বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) ও মেট্রোরেল।

ঢাকা নগরীকে কয়েকটি রুটে (রুট নং-১, ২, ৪, ৫ ও ৬) বিভক্ত করে মেট্রোরেল নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীন ডিএমটিসিএল মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হবে। এছাড়া ২০২২ সালের মার্চে মেট্রোরেল লাইন-১ নির্মাণের কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।

এদিকে ১৮৬১ সালে যাত্রা শুরু করা রেলওয়ে ধীরে ধীরে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে রেলওয়ে অপারেশনাল সিস্টেমকে আরও নিরাপদ করার জন্য আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম সংযোজন করা হয়েছে। আর রেলওয়ে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন স্তর ও পদবির প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল, প্রয়োজন জনবল প্রশিক্ষণের নিজস্ব অবকাঠামো, রুলস-কোডস ম্যানুয়াল। বাংলাদেশ রেলওয়ে শত বছর ধরে এসব অবকাঠামো, রুলস-কোডস ইত্যাদি অনুযায়ী নিরাপদে রেল পরিচালনা করছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর পৃথক রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। ফলে রেলওয়ে পরিচালনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম আরও গতি লাভ করে। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টির ফলে পিছিয়ে পড়া রেলওয়ের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন ও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ নির্মাণ, যমুনা নদীতে পৃথক রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পসহ নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে রেলওয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলওয়ে, ভাঙ্গা-পায়রা রেলপথ নির্মাণের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এছাড়া বাস্তবায়নাধীন এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পে নবনিয়োগকৃত প্রকৌশলী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর শিডিউল-১-এর অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে এরূপ সংস্থান রয়েছে: ‘১. ফরমুলেশন অব পলিসিস রিগার্ডিং বাংলাদেশ রেলওয়ে অ্যান্ড আদার রেল রিলিটেড ট্রান্সপোর্ট লাইক মেট্রো ইটিসি। ২. ডেভেলপমেন্ট, ইম্প্রুভমেন্ট অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অব বাংলাদেশ রেলওয়ে অ্যান্ড আদার রেল রিলেটেড ট্রান্সপোর্ট লাইক মেট্রোরেল ইটিসি।’

এরূপ সংস্থান অনুযায়ী প্রতিভাত হয় যে, মেট্রোরেল-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ তথ্য পরিচালনা সরকার কর্তৃক রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ অনুযায়ী ডিএমটিসিএল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল লাইন-৬ পরিচালনা এবং মেট্রোরেল ১, ২, ৪ ও ৫ বাস্তবায়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করার জন্য বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে মেট্রোরেল নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিএমটিসিএলকে নিয়োজিত করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী মেট্রোরেল নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রেলওয়ের ওপর ন্যস্ত করা আছে। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে। তিনি অনুমোদন দিলেই কেবল তা সম্ভব হবে।

যদিও এটি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত প্রস্তাব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, রেলওয়ে ও মেট্রোরেল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিবহন ব্যবস্থা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মেট্রোরেল পরিচালনার দায়িত্ব নগর পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওপর। তাই বাংলাদেশও এক্ষেত্রে সঠিক পথেই আছে। ডিএমটিসিএলকে পৃথক সংস্থা হিসেবে মেট্রোরেল পরিচালনা করতে দেয়া উচিত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০