কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ

মেট্রোরেল নিয়ে বিরোধে সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়

ইসমাইল আলী: রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬)। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়েছে। তবে গত বছর অক্টোবরে মেট্রোরেলটি মতিঝিলের পরিবর্তে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুপারিশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে কমলাপুরে মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণে রাজি নয় রেলওয়ে। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি বিষয়টি সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শরণাপন্ন হয় দুই মন্ত্রণালয়ে। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত গেছে রেলওয়ের বিপক্ষে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এবং এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক।

সূত্রমতে, দুই ভাগে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। আর আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের অগ্রগতি প্রায় ৪৮ শতাংশ। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর মেট্রোরেলের লাইনটি কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এ জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও করা হয়েছে।

বর্তমানে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আর মতিঝিল-কমলাপুরের অংশটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এতে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এছাড়া উড়ালপথে (এলিভেটেড) নির্মাণাধীন এ মেট্রোরেলে ১৬টি স্টেশন ছিল। তবে কমলাপুর যুক্ত হওয়ার এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭তে। যদিও বর্ধিত অংশ যেন মূল মেট্রোরেল নির্র্মাণ পরিকল্পনায় বিঘœ না ঘটায় সে জন্য কাজ করছে ডিএমটিসিএল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী কমলাপুরে যাতায়াত করেন। সেখান থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বাস বা সিএনজি অটোরিকশাই প্রধান ভরসা যাত্রীদের, যা অনেক সময়ই প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। তবে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের ফলে ঢাকায় আসা ও ঢাকা ছেড়ে যাওয়া রেলের যাত্রীরা মেট্রোরেল ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। আবার মেট্রোরেলের উপযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে। যদিও এমআরটি লাইন-৬ সম্প্রসারণ করা হলে বর্ধিত অংশটি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীসেবায় বিঘœ ঘটানোর পাশাপাশি স্টেশনের আধুনিকায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

গত জানুয়ারিতে এ বিষয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে রেলপথ সচিব ও রেলওয়ের মহাপরিচালক কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কঠোর বিরোধিতা করেন। এছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কেন এ উদ্যোগ নিয়েছে এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পাশাপাশি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

যদিও মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় ওই বৈঠক আর অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে গত মাসে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।

বৈঠকে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানান, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতে কমলাপুর প্রান্তে মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণে সোশ্যাল সার্ভের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাকে (জাইকা) অনুরোধ করা হয়েছে। এ সময় তিনি প্রস্তাবিত স্টেশনের অবস্থান ও এ রুটকে সচল করার জন্য প্রস্তাবিত স্টেশনের শেষ প্রান্তে ‘সিজার ক্রসওভার’ নির্মাণের আবশ্যিকতা সম্পর্কে ড্রয়িং ও স্যাটেলাইট ইমেইজসহ পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে সভায় বিস্তারিত অবহিত করেন।

তিনি আরও জানান, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) ২০১৫-২০৩৫তে এমআরটি লাইন-৬ কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুপারিশ রয়েছে। আবার ২০১৮ সালে এমআরটি লাইন-১ এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়েও এমআরটি লাইন-৬ কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের জন্য সোশ্যাল সার্ভে শুরু করা হয়েছে। বর্তমানে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। স্টেশনের অবস্থান চূড়ান্ত হওয়ার পর এক মাসের মধ্যে সোশ্যাল সার্ভে সম্পন্ন করা হবে।

সভায় আরও জানানো হয়, কমলাপুর এলাকায় মেট্রোরেলের স্টেশন নির্মাণের জন্য ডিএমটিসিএল ও রেলওয়ের কারিগরি দল গত ১৮ আগস্ট এক সভা করে। সভায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলোÑকমলাপুর স্টেশন এলাকায় এমআরটি-৬-এর স্টেশন অপশন-১ (পাশাপাশি) অনুযায়ী স্টেশন এলাকায় ও সংলগ্ন সার্কুলার সড়ক সমন্বয়ে নির্মাণ করা যায়। তবে এমআরটি লাইন-৬ স্টেশনের শেষ প্রান্ত কমলাপুর স্টেশনের নারায়ণগঞ্জ প্ল্যাটফর্মের প্রবেশ সড়কের সীমানার মসজিদ সংলগ্ন প্রান্তে সীমাবদ্ধ রাখার শর্ত আরোপ করা হয়। এছাড়া এমআরটি লাইন-১, লাইন-২ ও লাইন-৪-এর স্টেশনগুলো কমলাপুর মাল্টিমোডাল হাবের ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানের গ্রিনজোনের মধ্যে পাতালে (মাটির নিচে) নির্মাণ করা যায়।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বিষয়ে বৈঠকে জানান, অপশন-১ অনুযায়ী কমলাপুরে এমআরটি লাইন-৬-এর স্টেশনের বর্তমান অবস্থান কার্ভ সেকশনের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে। ফলে স্টেশনের আগে ‘সিজার ক্রসওভার’ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য স্টেশনের পরে ‘সিজার ক্রসওভার’ নির্মাণ করা অপরিহার্য।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বিষয়টি নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণ জানতে চান। তখন ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টিমোডাল হাব অ্যাট কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন’ প্রকল্পের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজি একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে কমলাপুর স্টেশন এলাকায় রেলওয়ের সাতটি, ডিএমটিসিএলের চারটি, রাজউকের মালিবাগ-ঝিলমিল ফ্লাইওভারের আপডাউন র‌্যাম্প এবং সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত সাবওয়ে (ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল) ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আপডাউন র‌্যাম্পের অবস্থান তুলে ধরে বিস্তারিত উপস্থাপনা করেন।

বিস্তারিত আলোচনা শেষে মুখ্যসচিব অভিমত ব্যক্ত করেন, রেলওয়ে যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছে সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের নিশ্চিত করার জন্যই কমলাপুর প্রান্তে এরআরটি-৬-এর স্টেশন নির্মাণ অধিকতর যুক্তিযুক্ত। তিনি গুরুত্বারোপ করেন, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো প্রধানমন্ত্রী নিজে মনিটরিং করেন। আর সম্প্রসারিত এমআরটি লাইন-৬-এর প্রস্তাব দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যিক।

এ সময় মুখ্য সচিব কমলাপুর প্রান্তে এমআরটি লাইন-৬-এর স্টেশন ও স্টেশনের শেষ প্রান্তে ‘সিজার ক্রসওভার’টি নির্মাণে রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে নির্দেশনা প্রদান করেন। যদিও এ সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট নন রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে নির্মাণের মাঝপথে মেট্রোরেল বর্ধিত করার এ সিদ্ধান্তকে ‘অদূরদর্শী’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হতে চলল। এখন লাইনটা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো। এটা অনেকটা জোড়াতালি দেওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সেটা সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। আর সমন্বয়হীনতার এ উন্নয়ন ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনাটিকে দিন দিন জটিল করে তুলছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন করা মেট্রোরেল প্রকল্প। আর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুনে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। সে অনুযায়ী এগিয়ে নেওয়া হচ্ছিল নির্মাণকাজ। তবে করোনার কারণে এ প্রক্রিয়া অনেকটাই ঝুলে গেছে। ফলে নির্মাণ শেষে কবে এ মেট্রোরেল উদ্বোধন করা যাবে, তা এখন নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই।

এদিকে মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাক। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কেটি ৪৮ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে। তবে মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করায় এ ব্যয় বেড়ে যাবে। এছাড়া করোনার কারণে নির্মাণকাজ বিলম্ব হওয়াও ব্যয় বাড়বে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০