ইসমাইল আলী: রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। তবে এটি কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হবে। এতে দৈর্ঘ্য বাড়বে এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এজন্য মতিঝিল-কমলাপুর অংশের ডিজাইন প্রণয়ন চলছে। তবে করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। এতে দেড় বছর বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পটির মেয়াদ।
দৈর্ঘ্য বাড়ায় ওই অংশের নির্মাণব্যয় নতুন যুক্ত হবে। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া আয় বৃদ্ধির জন্য মেট্রোরেলের স্টেশন এলাকায় নির্মাণ করা হবে স্টেশন প্লাজা। স্টেশনে ওঠানামার জন্য ফুটপাতের পাশে জমি/বাড়ি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ খাতেও ব্যয় বাড়বে। সব মিলিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণব্যয় বাড়ছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামীকাল তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের কথা রয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির বিস্তারিত প্রস্তাব তুলে ধরা হবে।
তথ্যমতে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল তথা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট-৬ (এমআরটি-৬) নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাইয়ে অনুমোদন করা হয়। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ টাকা। তবে সংশোধিত হিসাবে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ মেট্রোরেল নির্মাণব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বা ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি খাতের ব্যয়ই বাড়ছে বেশি।
এমআরটি-৬ নির্মাণে প্রাথমিকভাবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ দেয়ার কথা ছিল ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারের দেয়ার কথা ছিল পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে সংশোধিত হিসাবে জাইকা ঋণ দেবে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হবে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
এদিকে আগামী ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশটি উদ্বোধনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশটি উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর। আর মতিঝিল-কমলাপুর পর্যন্ত অংশ উদ্বোধন করা হবে ২০২৪ সালে। এছাড়া নির্মাণ-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এক বছর রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর। বর্তমানে তা ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে যাচ্ছে দেড় বছর।
ব্যয় বৃদ্ধির খাত বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পটির সাধারণ পরামর্শক খাতে ৫৭৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) তথা ফুটপাত সম্প্রসারণ অংশের পরামর্শক খাতে ব্যয় বাড়ছে ১৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া সিডি-ভ্যাট খাতে অতিরিক্ত লাগবে ৮৬২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। মূলত সরকারিভাবে করহার ১৩ দশমিক ৪২ থেকে বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ করায় এ ব্যয় বাড়ছে। আর প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে ব্যয় বাড়ছে ১১৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এদিকে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করতে গিয়ে নির্মাণকাজে ৭১৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, বৈদ্যুতিক ও মেকানিক্যাল ব্যবস্থা (ইঅ্যান্ডএম) স্থাপনে ৩২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং রোলিং স্টক (ইঞ্জিন-কোচ) খাতে ৫০ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ বর্ধিত অংশের জন্য ব্যয় বাড়ছে মোট এক হাজার ৮৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির রাজস্ব খাতের ব্যয়ের মধ্যে মেট্রোরেলের ট্রায়াল রানে ব্যবহƒত বিদ্যুৎ বিল খাতে ২০০ কোটি টাকা, বেতন-ভাতা খাতে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা, অফিস ভাড়া খাতে এক কোটি ২৯ লাখ টাকা, সভা/সেমিনার আয়োজনে এক কোটি ১০ লাখ টাকা, বিটিআরসির লাইসেন্স ফি বাবদ এক কোটি টাকা, পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে ১০ কোটি টাকা, মেট্রোরেল পরিচালনায় প্রশিক্ষণ খাতে পাঁচ কোটি টাকা ও ডিজিটাল আর্কাইভ খাতে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ছে।
প্রকল্পটির নির্মাণ খাতের মধ্যে স্টেশন প্লাজা নির্মাণে ৯২ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ইঅ্যান্ডএম স্থাপনে (প্যাকেজ-০৭) দুই হাজার ২৫৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা, রোলিং স্টক (সিপি-০৮) কেনায় ৮৫১ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং টিওডি খাতে ৮৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ছে।
এর বাইরে রাজউকের শূন্য দশমিক ৪৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ১৩০ কোটি টাকা, স্টেশন প্লাজার জন্য ১১টি সরকারি সংস্থার ছয় দশমিক ১২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে তিন হাজার ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও মতিঝিল-কমলাপুর অংশের জন্য দুই দশমিক ৪০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে এক হাজার ১৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় হবে। আর সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের হার বাড়ানোয় বিভিন্ন মৌজায় ৪৫৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। সব মিলিয়ে জমি অধিগ্রহণ খাতে অতিরিক্ত লাগবে পাঁচ হাজার ৩৬৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
এদিকে উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপোর ভূমি উন্নয়নে (সিপি-০১) ৬৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। একইভাবে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার অংশ (সিপি-০৫) নির্মাণে সাশ্রয় হচ্ছে ৬৯১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এতে দুই প্যাকেজে ৭৬০ কোটি ৬৩ লাখ ব্যয় কমবে। সব মিলিয়ে এমআরটি-৬ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।