মেঠোপথে মাতৃভূমি দর্শন

আমাদের বন্ধুত্ব পাঁচ বছরে পদার্পণ করেছে। ৯ জনের বন্ধুত্বে চার বছরে এতটুকুও চিড় ধরেনি। বন্ধুত্বকে সজীব করে রাখতে আমরা প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণে যাই। এবার যেমন দেশের দুটি সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ ভ্রমণ করে এলাম।

গত ৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহগামী শামীম পরিবহনের একটি বাসে চড়ে আমরা ৯ জন ময়মনসিংহে যাই। এখান থেকেই শুরু অ্যাডভেঞ্চার। পরে

ময়মনসিংহ ব্রিজ থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে রওনা হই নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দা গ্রামের পথে। আমার জš§ মেঘালয় ঘেঁষা বাঘবেড় গ্রামে হলেও গ্রামের সৌন্দর্যকে এতটা এর আগে উপভোগ করা হয়নি কোনোদিন। এবার যেন বাকি বন্ধুদের মতো আমার চোখেও সৌন্দর্য-দেবী ভর করেছিল।

পরদিন সকালে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই বন্ধুদের। হেমন্তের অপরূপ রূপে গ্রামটি সেজেছিল নতুন বৌয়ের সাজে! নেত্রকোনা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে কলমাকান্দা, আমার গ্রাম। মাঠে সোনালি ধান আর মেঘালয় পাহাড়ের মিতালি গ্রামটিকে করে তুলেছে এক খণ্ড সবুজের বুকে এক টুকরো সোনার খনি। সকাল ৯টায় যখন আমরা গ্রামে পৌঁছাই, তখনও হেমন্তের শিশির বিদায় নেয়নি। হালকা শীতের আগমন আমাদের ক্লান্ত দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। দূরের দুর্গম রাস্তা আর ভাঙাচোরা মেঠোপথ পার হয়ে বাড়িতে পৌঁছাই। এজন্য বন্ধুরা আমার ওপর খুব রেগে গিয়ে বলেই ফেলেছিলÑআমি নাকি তাদের শাস্তি দিচ্ছিলাম! এতদূর থেকে কেউ পড়ালেখা করতে যায়? পরে অবশ্য পাহাড়ি এলাকা আর গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে আমায় ওরা বুকে টেনে নিয়েছিল।

বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। গ্রামটিতে শিক্ষার হার মাত্র পাঁচ শতাংশ। আমিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) পড়ালেখা করছি। সারা রাত গাড়িতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের পর সবার ফোনের চার্জও প্রায় শেষ। গ্রামের এক কোণে দোকানে গিয়ে ওদের ফোন চার্জে দিতে হয়েছিল। এত কষ্ট করে বাড়িতে পৌঁছানোর পর মা আমাদের জন্য দেশি খাবার (টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছ, ভর্তা, শিম-টমেটোর তরকারি) রান্না করে রেখেছিলেন, সঙ্গে ছিল গরুর মাংস। আরও ছিল পূর্ববঙ্গের নানা জাতের পিঠা।

দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে আমরা বাড়ির সামনে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের কাছে ঘুরতে যাই। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ, ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে হাঁটলেই মেঘালয়। ওখানের পাহাড়ের বিশালতা বন্ধুদের ক্লান্তি দূর করে খানিক সময়ের জন্য ভাবুক করে তুলেছিল। সারা দিন গ্রাম আর পাহাড়ি এলাকা ঘুরে বাজারে যাই রাতে। আমাদের ৯ জনের মধ্যে তিনজন প্রমীলা সদস্যও ছিল।

পরদিন সকালে নানা বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া আর গানের আড্ডা দিয়ে বিকালে চলে যাই সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা মহিষখোলা গ্রামে। বলা ভালো, আমাদের গ্রাম থেকে সুনামগঞ্জের সীমানাও কাছে। আমাদের এ অঞ্চলটি এতটাই প্রত্যন্ত যে, পুরোটাই মেঠোপথ; এখানে অটোরিকশা চলতে পারে না। মহিষখোলায় যেতে বাজার থেকে ভাড়ায় বাইক পাওয়া যায়। আমরা পাঁচটি বাইক নিয়ে মহিষখোলায় খালার বাড়িতে যাই। রাতভর সেখানে আড্ডা ও ঘুমিয়ে পরদিন সকালে খালাতো ভাইসহ পাঁচটি ভাড়া বাইক নিয়ে রওনা হই সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান নীলাদ্রি, বারাক্কা টিলা, যাদুকাটা নদী ও শিমুলবাগান দেখতে। খালার বাড়ি থেকে পূর্বদিকে মেঘালয়ের পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার রাস্তা বাইকযোগে যেতে হয়। কিছুটা পাকা হলেও ৩৫ কিলোমিটারের মতো রাস্তা কাঁচা। তার ওপর যেদিন আমরা ঘুরতে বের হই, সেদিন আবার ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ পুরো দেশে আঘাত হেনেছে। মাথার ওপর বিষণ্ন আকাশ আর নিচে এক হাঁটু কাদার রাজত্বকে অবহেলা করে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাই। একদিকে মেঘালয় পাহাড়, আরেকদিকে টাঙ্গুয়ার হাওরের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতেই গন্তব্যের দিকে যেতে থাকি। দিনভর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়-হাওরের মিতালিতে সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ ঘুরে বেড়িয়ে আমরা রাতে বাড়ি ফিরি। তবে যাওয়ার সময় বাইকে চড়ে যেতে পারলেও আমাদের বাড়িতে ফিরে আসার সময় আর বাইকে চড়ার মতো অবস্থা ছিল না। কাদায় আটকে যাচ্ছিল। রাস্তাতেই হাঁটু সমান কাদা ছিল। ‘বুলবুল’ আমাদের ভ্রমণটাকে যেন কেড়ে নিতে চেয়েছিল; তবে তারুণ্যের কাছে সে হার মানতে বাধ্য হয়।

সুনামগঞ্জ পর্ব শেষ করে বাড়িতে চলে আসি। পরদিন আমাদের গন্তব্য নেত্রকোনার দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করা। জেলাটির সীমান্তবর্তী সমৃদ্ধ উপজেলা দুর্গাপুরের বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়ে যাই সেদিন। এছাড়া সোমেশ্বরী নদীর অপরূপ ঐশ্বর্য আমাদের চোখ এড়াতে পারেনি। টন টন বালি ও পাথর নদী থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে ড্রেজার দিয়ে, যা আমাদের অর্থনীতিকে করছে শক্তিশালী। এছাড়া দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি পরিদর্শন করে আমরা তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাই।

পরে কলমাকান্দার নানা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করি। এরপর ফিরে আসি বাড়িতে। সেদিন রাতে মায়ের হাতের প্রিয় খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাই। উদ্দেশ্য শরীরের ক্লান্তি দূর করা; কারণ পরদিন সকালে ফিরতে হবে প্রিয় বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১১ নভেম্বর সকালে মায়ের মায়ার জাল ভেঙে আমরা ফিরতে থাকি। রাবিতে ফিরে আসার দিন ময়মনসিংহ পর্যন্ত অটোরিকশাযোগে রাজশাহীর বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা স্থাপনা ও গবেষণা আমাদের মুগ্ধ করেছে। ওইদিন ঠিক বেলা ৩টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বাসে উঠি।

পাঁচ দিনের স্মৃতি, গ্রামের সোনালি ধান, মেঘালয় পাহাড়, গাঁয়ের মেঠোপথ আর মা  যেন আমাদের পিছু ডাকছিল। হƒদয়ে শূন্যতা অনুভব করছিলাম; তবুও পেছনে ফিরে তাকাইনি, লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে আসি এটাই হয়তো মাটির মায়া। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়:

‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে

আমাদের ছোট গাঁয়

গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়?’

  নাজমুল মৃধা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০