হামিদুর রহমান: প্রবাসী শ্রমিকদের ভিসা চূড়ান্ত হলে মেডিকেল টেস্টের প্রয়োজন হয়। তবে মালয়েশিয়ার এখন পর্যন্ত কোনো ভিসা নিশ্চিত না হলেও মেডিকেল টেস্টের নামে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন এজেন্সি। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও অনেকটা দায় ছাড়া। নেই মনিটরিং ব্যবস্থা।
অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের পাসপোর্ট আটকে রেখে রাজধানীজুড়ে ‘গণহারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হচ্ছে। বিভিন্ন এজেন্সি বিদেশগামী প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে আদায় করছে সাত থেকে দশ হাজার টাকা। বিদেশগামী এসব কর্মীর বেশিরভাগ আসেন দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। আসা-যাওয়ায় একদিকে নষ্ট হচ্ছে সময়, অন্যদিকে যাতায়াত ও হোটেল ভাড়ায় ব্যয় হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ।
শুধু মেডিকেল করিয়ে এজেন্সি লাখো বিদেশগামীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এখনই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে আরও অনেক মানুষ প্রতারিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মালয়েশিয়ায় ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃত্তরা।
রাজধানীর বনানী এলাকায় অবস্থিত আল এমিরেট মেডিকেল সার্ভিসেস। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। জানতে চাইলে শ্রমিকরা জানান, দুই মাস আগে তাদের ভিসা দেয়ার কথা থাকলেও এখনও তারা ভিসার কোনো নিশ্চয়তা পাননি। তবে মেডিকেল টেস্টের জন্য তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে।
গাইবান্ধা থেকে মেডিকেল টেস্টের জন্য এসেছেন মাইনুল মিয়া। তিনি জানান, এলাকার পরিচিত এক আত্মীয়র মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যেতে বসুন্ধরা নামে এক এজেন্সিকে টাকা দিয়েছি। তবে ভিসা এখনও হাতে পাইনি। তারা বলছে, মেডিকেল টেস্ট হয়ে গেলে ভিসা দিয়ে দেবে। এখন মেডিকেল করতে এসেছি। মেডিকেলের জন্য ৭ হাজার টাকা নিয়েছে।
প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানালেন মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক আরেক জন শ্রমিক আব্দুল বাছেদ। তিনি বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে মালয়েশিয়া যেতে চেষ্টা করছি। ভিসা হয়ে গেছে তবে এখনও হাতে পাইনি। মেডিকেল টেস্ট করা হলেই ভিসা দিয়ে দেবে। মেডিকেল আগেই করেছি সাত হাজার টাকা দিয়ে, এখন রিপোর্ট পেলাম। মেডিকেল রিপোর্টও ভালো এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেডিকেল করতে এসে যা বুঝলাম এরা একেক জনের থেকে একেক রকমভাবে ফি নিচ্ছে।’
পরে আল এমিরেট মেডিকেল সার্ভিসে মেডিকেল টেস্টের ফি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানায়, মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের মেডিকেল ফি সাত হাজার টাকা। যেসব টেস্ট করা হয় তার মধ্যে হেপাটাইটিস বি, রক্তের গ্রুপ, সুগার লেভেল টেস্টের জন্য বিলি রুমিং, এক্স-রে প্রভৃতি।
অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ইমেজিং সেন্টার নামে বনানীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কথা হলে তারা জানায়, মালয়েশিয়া শ্রমিকদের মেডিকেল ফি নেয়া হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। পল্টনে অবস্থিত ডায়াগনস্টিক মেডিকেল সেন্টারে মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের মেডিকেল ফি নেয়া হচ্ছে ৬ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রথম ধাপের যে ৬৮টি মেডিকেল সেন্টারের নাম প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে মালয়েশিয়া সরকারের তালিকাভুক্ত ৩২টি মেডিকেল সেন্টারের দেয়া তালিকার মধ্যে রয়েছে মাত্র ৮টি মেডিকেল সেন্টারের নাম। এখন বাকি মেডিকেল সেন্টারগুলো থেকে যদি কোনো শ্রমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায় তাহলে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
উল্লেখ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেশনের কারণে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে এক চিঠি দিয়ে কর্মী না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। চিঠি চালাচালির পর কূটনৈতিক চেষ্টায় আবার দুই দেশের মধ্যে নতুন করে এমওইউ চুক্তি হয়। এরপর শ্রমবাজারের জট খুলতে শুরু করে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে ৭টি রিক্রুটিং এজেন্সির নামে মালয়েশিয়াগামী হাজারো শ্রমিকের নামে নিয়োগ অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী, এসব কর্মীকে বিএমইটির ডেটা ব্যাংক থেকে বাছাই করতে হবে। তবে এর বিপরীতে প্রায় এক লাখের ওপর কর্মীকে ইতোমধ্যে নানাভাবে বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়েছে বলে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে।
রাজধানীর গুলশানে স্বপন নামে একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী জানান, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর আগে কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে রাজধানীজুড়ে প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মতিঝিল, গুলশান ও বনানী এলাকার চিহ্নিত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের দেয়া সিøপ নিয়েই ওই চক্রটি যে যার যার মতো মেডিকেল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ মেডিকেল সেন্টারে মালয়েশিয়াগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর কোনো অনুমোদন তারা এখনও পাননি বলে শুনেছি।
জনশক্তি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার ঢাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে মেডিকেল সেন্টার যাচাই-বাছাই করে ৩২ মেডিকেল সেন্টারকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে যে ৬৮টি মেডিকেল সেন্টারের নাম প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে মালয়েশিয়া সরকারের দেয়া ৩২টির মধ্যে শুধু ৮টির নাম রয়েছে। বাকিগুলোর নাম নেই।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, লোক নেবে মালয়েশিয়া। অথচ তাদের বাছাই করা মেডিকেল সেন্টারের বেশিরভাগেরই নাম তালিকায় নেই। এখন কীভাবে মালয়েশিয়ায় লোক যাবে তা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছি। ইতোমধ্যে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি ও তাদের মনোনীত বহু রিক্রুটিং এজেন্সি যে যার মতো মেডিকেল করাচ্ছে। এখন এসব স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টকে মালয়েশিয়া সরকার কতটুকু বৈধতা বা গুরুত্ব দেবে তা নিয়ে সন্দিহান। এসব কর্মীকে আবার পরে মেডিকেল করানো হবে বলে আমার মনে হচ্ছে।
আটটি মেডিকেল সেন্টার হচ্ছেÑহিউম্যান ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টার, পারফেক্ট মেডিকেয়ার লিমিটেড, রেইনবো হার্টস মেডিকেল সেন্টার, এপেক্স ডায়াগনস্টিক সার্ভিস, এসকেএন হেলথ সার্ভিস, রাজধানী ডিজিটাল, আল হামাদ মেডিকেল ও গুলশান মেডিকেয়ার লিমিটেড।
এ বিষয়ে বায়রার সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার শেয়ার বিজকে বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অবগত। গত পরশু আমরা মন্ত্রণালয়ে বলেছি, ভিসার কোনো খবর নেই। এভাবে গণহারে সাধারণ শ্রমিকদের মেডিকেল করিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত বছরও এভাবে প্রায় আট লাখ শ্রমিকের মেডিকেল করিয়েছে; যারা এখনও মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এটা বন্ধ করা দুষ্কর।
তিনি বলেন, যারা মালয়েশিয়াগামী শ্রমিক, এরা বেশিরভাগ গরিব মানুষ, গ্রামের মানুষ। এরা প্রতিনিয়ত এভাবে প্রতারণার শিকার হলেও সরকার এসবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে যে ৬৮টি মেডিকেল সেন্টারের নাম পত্রিকার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় এসব মেডিকেল সেন্টারের মালিকরা কাতার, ওমান সৌদি আরবসহ সব দেশেই কর্মী পাঠানোর জন্য মেডিকেল সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারবেন। তবে অযথা কেউ মেডিকেলের নামে অর্থ হাতিয়ে নিলে আমাদের কাছে এমন অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।