Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:05 pm

মেনোপজ: ইতিবাচক চিন্তা ও নারীর ভালো থাকা

শানু মোস্তাফিজ: মিথিলা আশরাফ, বয়স ৪৮। কিছুদিন থেকে তার হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড গরম লাগে। কান দিয়ে গরম ভাপ বের হয়। মাথা গরম হয়ে যায়। এ রকম পরপর কয়েকবার হলে মিথিলা অস্থির হয়ে যান। গোসল করেন। এরপরও শান্ত হয় না। তার যেন মনে হয় শরীর এখনও অনেক গরম হয়ে আছে। মেপে দেখেন তার উচ্চ রক্তচাপ বেড়েছে। এরপর তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। তিনি সুস্থবোধ করেন এবং পরে উচ্চ রক্তচাপ মেপে দেখেন তা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মিথিলা ভয় পান এবং চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলে চিকিৎসক তার সব কথা শুনে বলেন, তার মেনোপজ বা ঋতুবন্ধ হয়েছে। মিথিলা বলেন, ‘যখন আমার শরীর খারাপ লাগে, তখন বিষয়টি নিয়ে বেশি অস্থির হলে সুস্থ হতে সময় লাগে। কিন্তু যখন বিষয়টিকে কোনো আমলে নেই না বা অন্য কাজে ডুবে যাই, তখন দ্রুত সুস্থ বোধ করি।’

‘বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি’র এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩০ লাখ ঋতুবন্ধ নারী রয়েছেন। এর সঙ্গে প্রতি বছর ৮০ হাজার নারী যোগ হন। এসব নারীর চিকিৎসায় প্রয়োজন সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মালিহা রশিদ বলেন, “নারীদের জীবনে ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে। এটা নির্ধারিত। সাধারণত চল্লিশের পর থেকে বায়ান্ন বছরের মধ্যে নারীর নিয়মিত ঋতুচক্র থেমে যায়। অনেক সময় এর আগে বা পরেও তা হয়। শরীর থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন ও অন্য দুই একটি হরমোন নিঃসরণ এ সময় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় একেই বলে ‘মেনোপজ’।” তিনি আরও বলেন, ‘ওভারি (ডিম্বাশয়) থেকে হরমোন নিঃসরণ থেমে যাওয়া বা ঋতুনিবৃত্তি কোনো অসুখ নয়। তবে এর কিছু ক্ষণস্থায়ী প্রভাব রয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি আগের নারীরা এটা সহজেই মেনে নিতেন। কিন্তু এখনকার নারীরা বিষয়টি নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করেন এবং সহজেই মেনে নিতে পারেন না। বিশেষ করে তারা এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত হন। এটা ঠিক নয়। এর ক্ষণস্থায়ী প্রভাবগুলো সহজভাবে মেনে নিলে জটিলতা কম হবে।’

ক্ষণস্থায়ী প্রভাবগুলো যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সে জন্য সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপ করতে হবে বলছেন চিকিৎসকরা। মোনোপজের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে হঠাৎ প্রচণ্ড গরম লাগা, রাতে ঘেমে যাওয়া এবং পর মুহূর্তে দুর্বল লাগা, খিটিমিটি মেজাজ, অস্থিরতা, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, সঙ্গমে অনীহা, যোনিদ্বারে শুষ্কতা, যৌনমিলনে ব্যথা, হঠাৎ মুড পরিবর্তন হওয়া, বুক ধড়ফড়ানি, হঠাৎ উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হওয়া, কান দিয়ে গরম ভাপ বের হওয়া এবং পরক্ষণেই তা কমে যাওয়া ইত্যাদি। ডা. মালিহা আরও বলেন, ‘অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেনোপজ সমস্যার কারণে অনেক সময় মধ্যবয়সী নারীদের সমস্যাগুলো স্বামীরা বুঝতে চান না এবং তাদের বোঝাপড়ায় সমস্যা তৈরি হয়। এসব কারণে অনেক নারীর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়।’ তিনি জানান, ‘মেনোপজ হলে মানসিক চাপ বাড়ে। বুক ধড়ফড় করলে নারীভাবে তার হার্টে সমস্যা হয়েছে এবং সে ভয় পায়। আবার হটফ্লাস হলে সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে এবং শরীর খারাপ হয়, এতেও সে ভয় পায়। এই ভয় থেকে তার সমস্যা বাড়তে থাকে। বিষয়টি ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে না পারার জন্য এ সময় অনেকের উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা স্থায়ী হয়ে যায়। অনেক সময় নারী বিষণœতায় ভোগেন। ভাবেন, তার জীবন যৌবন বুঝি শেষ হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ‘শারীরিক সমস্যাগুলো এমন হয় যে, কেউ কেউ এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ ধরনের সমস্যাগুলো দুই এক বছরের মধ্যে কমে যায়। তাই যে কোনো সমস্যা হলে এ সময় কাউন্সিলিং করাতে হবে। আমাদের দেশে এর প্রচলন খুবই কম। অনেকে সমস্যা বলতে চান না। কিন্তু পরিচিত কারও সঙ্গে বা চিকিৎসকের মাধ্যমে কাউন্সিলিং করলে তিনি জানতে পারবেন, এ সমস্যাগুলো অন্যদেরও হয় এবং এগুলো একসময় ঠিক হয়ে যায়। শুধু সমস্যাগুলো নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করলে তা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়। তবে সবার মেনোপজে সমস্যা হয়, এমন নয়। অনেকে তেমন কোনো সমস্যা অনুভব করেন না। তাই এ সময় ভালো থাকা কোনো সমস্যা নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি ব্যবস্থা রয়েছে; যার নাম হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি)। এ থেরাপির মাধ্যমে শরীর থেকে যে হরমোন শুকিয়ে যায়, তা বাইরে থেকে জোগানোর ব্যবস্থা করা হয়। উন্নত বিশ্বের অনেক নারী এই হরমোন থেরাপি গ্রহণ করেন।’

শুধু সৌন্দর্য ও যৌবন ধরে রাখার জন্যই নয়, সুস্থ থাকার জন্যও হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর এইচআরটি। এক্ষেত্রে সব নারীদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এ সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন জানান, ‘এ বিষয়টি এখনও সেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। এর অসুবিধাগুলো প্রথমে সবার বুঝতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত প্রচারণা প্রয়োজন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি মাধ্যমগুলোয় শুধু নারীই নয়, পরিবারের অন্যদেরও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন। নারীরা সচেতন হলেই বুঝতে পারবেন তাদের কী করা উচিত। আমাদের এখানে যারা সদস্য নন তারাও কাউন্সিলিং সুবিধা পেতে পারেন।’

শুধু মেনোপজ সোসাইটি নয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় হাসপাতালগুলোয় এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল মেনোপজ আউটডোর ক্লিনিক নামে একটি হেলথ চেকআপ ব্যবস্থা চালু করেছে। তুলনামূলক কম খরচে এখানে মেনোপজের চিকিৎসা পাওয়া যায়। এখানকার চিকিৎসক ডা. ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘মেনোপজ সম্পর্কে এখনও নারীদের ধারণা নেতিবাচক। তারা বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে অনেক ভালো থাকবেন। তারা তা না করে ভাবতে শুরু করেন তাদের জীবন শেষ। এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। মেনোপজের কারণে হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ, হটফ্লাস, হাড়ক্ষয় বা হাড়ে ব্যথা ইত্যাদি হলে নিয়মিত চেকআপ করা প্রয়োজন এবং এসব অসুখকে বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই সমস্যা কেটে যায়। তবে সবচেয়ে প্রয়োজন স্বামী ও পরিবারের সহযোগিতা।’

তবে সবার সহযোগিতার আগে নিজেই নিজেকে সহযোগিতা করতে হবে। ভয় নয়, জানতে হবেÑএমনই মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল। তিনি জানান, ‘এক্ষেত্রে নারীর প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। এটাকে মেনে নিলে জটিলতা কমে যাবে। এ বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণাগুলো পরিহার করতে হবে। এ সময় জীবনকে নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা প্রয়োজন। খুশি ও আনন্দে থাকার অভ্যাস করতে হবে। কোনোরকম একেবারে দুশ্চিন্তা করা যাবে না। কারণ দুশ্চিন্তা থেকে নারী এ সময় নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন। এছাড়া এ বয়সে নারী তার চারপাশ থেকে অনেক আত্মীয়-পরিজন হারাতে শুরু করেন। সন্তানরা বড় হয়ে যায়। তাদের বিয়ে হয়। তারা দূরে সরে যায়। এতে নারী অনেকটাই একা হয়ে পড়েন। ফলে মনের অসহায়ত্বের সঙ্গে শরীরের এই পরিবর্তন তাকে আরও অসহায় করে তোলে।’

পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ বলেন, ‘এ সময় শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে বেশি। ক্যালসিয়াম ও সয়া জাতীয় খাবার তাকে ভালো রাখবে। দুধ, ডিমের সাদা অংশ, সামান্য বাদাম, গ্রিন টি, পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। লবণ ও চিনির পরিমাণ কমাতে হবে। প্রতিদিন পরিমাণ মতো লেবু খেতে হবে। লেবু হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। অবশ্যই হাঁটা এবং হালকা ব্যায়াম করতে হবে নারীকে।’

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, প্রফুল্ল মন, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, হরমোন থেরাপি এবং নিয়মিত চেকআপই মেনোপজ সমস্যায় নারীদের সহায়তা করতে পারে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা এবং ইতিবাচক চিন্তাভাবনা। এ সঙ্গে নারীর নিজেকে নিজের সহযোগিতা করা।

পিআইডি নিবন্ধ