সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বহরে থাকা আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ নামে দুই লাইটার জাহাজ দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এসব জাহাজ দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড অয়েল সরবরাহ করা হয়। এতে জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুসহ সবার জীবন উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া তেল পরিবহনে ঝুঁকিসহ বন্দর এরিয়াও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বহরে থাকা ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ নামে দুই লাইটার জাহাজ দিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জ্বালানি তেল লাইটারিং মাধ্যমে তেল পরিবহন করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এসব জাহাজ দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড অয়েল সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে নির্মাণ করা হয় ১৯৮৭ সালে ‘বাংলার জ্যোতি’ এবং নির্মাণ করা হয় ১৯৮৬ সালে ‘বাংলার সৌরভ’। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মেরিনটাইন অর্গানাইজেশনের নিয়মানুসারে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এসব জাহাজের আয়ুষ্কার শেষ হয়। এছাড়া ডাবল হাল বাটম যুক্ত লাইটার জাহাজ তেল পরিবহনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিএসসিকে ছাড় দেয়া হয়। কিন্তু সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের কার্যক্রম অর্থাৎ পাইপের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস শুরু না হওয়ায় বিপিসির তেল খালাসের জন্য বিএসসি জাহাজ পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিশেষ অনুমোদন দেয়। এতে জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুসহ সবার জীবন উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পুরোনো এ দুই জাহাজে শুধু মেইনটেন্যান্স খাতে খরচ হয় বছরে ৩০ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত সাত বছরে এ দুই জাহাজের পেছনে ২১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকায় একটি নতুন জাহাজ কিনতে পারত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।
গত সোমবার কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন জেটিতে (ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল খালাসের জেটি) নোঙর করা অবস্থায় ১১ হাজার ৭০০ টন নিয়ে ‘বাংলার জ্যোতি’ প্রথমে বিস্ফোরণ ও পরে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আর বিস্ফোরণে একজন ক্যাডেট ও অন্য দুজন মেরিন ওয়ার্কস কর্মীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তেলের ট্যাংকে বিস্ফোরণ না হয়ে জাহাজের ওপরের অংশে বিস্ফোরণ হওয়ায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা হয়েছে। আবারও চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ নামের ট্যাংকারে আগুন লেগেছে। গত শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে এ ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) এ ট্যাংকার থেকে ৩৬ নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছে। ট্যাংকারটিতে ৪২ নাবিক ছিলেন বলে জানায় বিএসসি। কোস্টগার্ড কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। সাগরে টহলরত কোস্টগার্ডের মেটাল শার্ক নামের স্পিডবোট গিয়ে প্রথমে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। মোট চারটি স্পিডবোট দিয়ে ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। রাত আড়াইটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বাংলার সৌরভ ট্যাংকারে তেল ছিল কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। কোস্টগার্ড আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং নাবিকদের উদ্ধারে কাজ করছে। এতে একজন মারা যান। কিন্তু এত বছরের পুরোনো জাহাজ দিয়ে কেন তেল পরিবহন করছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)? মেরিন, জ্বালানি সেক্টরসহ অনেকের কাছে এই প্রশ্ন উঠেছে।
গতকাল সকালে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, রাত সাড়ে ১২টায় জাহাজে কোনো কাজ ছিল না। জাহাজে চারটা পয়েন্টে আগুন দেখা যায়। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বন্দরের ৭টি টাগ একযোগে কাজ করে। আগুন নেভানোর দেড় ঘণ্টা পর আবার আগুন ধরে যায়। তাই আমাদের আশঙ্কা নাশকতা। বিএসসির এমডি বলেন, কয়েকদিন আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল। এরপর আগুন লাগল বাংলার সৌরভে। তাই আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপচেষ্টা। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা শনাক্ত করা উচিত।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে পাইপ লাইনে তেল খালাস (এসপিএম সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) কার্যক্রমটি শুরুর আগ থেকেই বলা হচ্ছিল তাদের জ্বালানি তেল বহির্নোঙর থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে লাইটার করে নিয়ে আসার জন্য। আর এ কাজে বিপিসিকে সাপোর্ট দিয়ে আসছিল বিএসসির দুই জাহাজ (বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ)। তবে এ জাহাজকে না চালানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌবাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে দফায় দফায় বলাও হচ্ছে। উল্লেখ, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের পরিশোধিত মূলধন ১৫২ কোটি। এর মধ্যে সরকারি মালিকানা ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ, উদ্যোক্তা পরিচালকদের ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৪ শতাংশ শেয়ার মালিকানাধীন রয়েছে। বর্তমানে শেয়ারদর ৭৬ টাকা ২০ পয়সা।
আর বছরের সর্বোচ্চ দর ১৩৪ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দর ছিল ৭২ টাকা ১০ পয়সা।