** মৈত্রী ট্রেনে কোনো স্টেশনে যাত্রী উঠানামার সুযোগ নেই, সেজন্য ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতা ছাড়া কোচে মদ লুকানোর সুযোগ নেই
** ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের রিলে রুম সংরক্ষিত রুমে যাত্রীর প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া মদ রাখার সুযোগ নেই
** ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মদ চোরাচালানের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহিৃত করতে এনবিআর থেকে রেল সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে
** মদ চোরাচালানের বিষয়ে ভারতীয় রেলওয়েকে অবহিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়েকে এনবিআরের অনুরোধ
রহমত রহমান: মৈত্রী এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে ছাড়লে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন ছাড়া স্টেশনে যাত্রী উঠানামার সুযোগ নেই। আর ছেড়ে আসার সময় ভারতীয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তল্লাশি করে। এরপরও এই ট্রেনে করে আসছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ। ট্রেনের সিট আর সিলিং ফলস এর ভেতরে সুকৌশলে লুকিয়ে আনা হচ্ছে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আনা এই মদ। তবে ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো যাত্রীর পক্ষে এভাবে মদ আনা সম্ভব নয় বলে মনে করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ২৫ জুলাই কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে মৈত্রী ট্রেনের দুইটি কোচের সিল ও ফলস সিলিংয়ে লুকানো ১৬০ লিটার বিদেশি মদ উদ্ধার করেন।
অপরদিকে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের রিলে রুম একটি সংরক্ষিত কক্ষ। যেখানে ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া সাধারণ মানুষ বা কোনো যাত্রীর প্রবেশাধিকারের সুযোগ নেই। তালাবদ্ধ ওই রুম থেকে একইদিন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দুইটি ব্যাগ থেকে ২৭ লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধার করেন। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মৈত্রী ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় মদ আসে। সেই মদ ওই রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সেখানে রাখার সুযোগ নেই। স্টেশনের ‘রিলে রুম থেকে মাদকদ্রব্য আটকের বিষয়ে দায়ীদের চিহিৃত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে’ বাংলাদেশ রেলওয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ১৮ সেপ্টেম্বর এই চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে মদ চোরাচালানের বিষয়টি ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ২৭ জুলাই কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন ও ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের রিলে রুমে মদ আটকের বিষয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন।
অপরদিকে, রেলওয়ে সচিবকে দেয়া দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস গোয়েন্দা ও নিলাম) আয়েশা তামান্না সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ভারত থেকে মদ চোরাচালানের তথ্য পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। এরই প্রেক্ষিতে ২৫ জুলাই মৈত্রী ট্রেনে কাস্টমস গোয়েন্দার একটি দল অভিযান পরিচালনা করেন। ওই দিন বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে কলকাতা থেকে ভারতীয় র্যা ক বিশিষ্ট মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এসে পৌঁছায়। যাত্রীরা নেমে আসার পর কাস্টমস গোয়েন্দার সদস্যরা ট্রেনের কোচ-এইচ৪ রুমে অভিযান চালায়। এসময় রুমের সিটের নিচ থেকে তিনটি ও ফলস সিলিং খুলে আটটটি কালো রঙের ব্যাগ ও কাগজে মোড়ানো কিছু মদের বোতল উদ্ধার করে। একইভাবে কোচ-এইচ২ রুমের সিটের নিচ থেকে দুইটি ও ফলস সিলিং খুলে ছয়টি কালো রঙের ব্যাগ ও কাগজে মোড়ানো কিছু সংখ্যক মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের রিলে রুমের ভেতরে মাদকদ্রব্য রয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য ছিলো। এরই প্রেক্ষিতে কোচে অভিযান শেষে কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার লিটন চন্দ্র দে-কে তালাবদ্ধ রিলে রুম খুলে দিতে অনুরোধ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। মাস্টার রিলের রুমে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং রুম খুলে দিতে বলেন। কিন্তু রুম খুলে দেয়া হয়নি। পরে স্টেশনের মাস্টারের সহায়তায় তালা ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরে জিআরপি পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে রিলে রুম থেকে দুইটি মদ ভর্তি ব্যাগ উদ্ধার করে কাস্টমস গোয়েন্দা। ওই দিন কোচ থেকে ১৬২ ও রিলে রুম থেকে উদ্ধার করা হয় ২৭ লিটার বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ।
এই বিষয়ে স্টেশন মাস্টার লিটন চন্দ্র দে একটি বিবৃতি দেন। যাতে মাস্টার উল্লেখ করেন, আমার কাছে রিলে রুমের চাবি ছিল না। রিলে রুমের ইনচার্জকে ফোন করলে তিনি জানান তিনি স্টেশনের বাইরে রয়েছেন। চাবি খালাসি সাইদুল এর কাছে রয়েছে বলে জানান তিনি। পরে সাইদুলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে আমার নির্দেশে তালা ভাঙ্গা হয়। রুম থেকে দুইটি ব্যাগ থেকে ২৭ লিটার বিদেশি মদ উদ্ধার করে কাস্টমস গোয়েন্দা। তবে মদ কিভাবে সেখানে এসেছে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি স্টেশন মাস্টার। এছাড়া দর্শনা রেলওয়ে ইমিগ্রেশন মৈত্রী ক্যাম্প এর ইনচার্জ এসআই হুমাউন কবিরও মদ আটকের বিষয় স্বীকার করে একটি লিখিত বিবৃতি দেয়।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছেন, ২৫ জুলাই মৈত্রী ট্রেন থেকে কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মালিকবিহীন ৩৪টি ভারতীয় শাড়ি, ১৫টি ওয়ান পিস, ১৬ কেজি কসমেটিকস উদ্ধার করেন। এছাড়া ভারতীয় পাসপোর্টধারী ফ্রিকোয়েন্ট যাত্রীর নিকট হতে ১৫ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। এর আগে একাধিকবার মৈত্রী এক্সপ্রেস থেকে মদসহ চোরাই পণ্য আটক করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর মদসহ প্রায় আড়াই কোটি টাকার পণ্য জব্দ করা হয়। একটি চক্র শুল্ককর ফাঁকি ও পণ্য চোরাচালানের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচল করা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনকে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
চিঠিতে বলা হয়, মৈত্রী এক্সপ্রেস বিরতিহীনভাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছায়। যাত্রাকালে কোনো স্টেশনে যাত্রী উঠানামা করানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই কোচের সিটের নিচ ও ফলস সিলিংয়ে মদের বোতল ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো চোরাকারবারি বা সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আর কুর্মিটোলার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের রিলে রুম একটি সংরক্ষিত কক্ষ। যেখানে ওই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া সাধারণ মানুষ বা কোনো যাত্রীর প্রবেশাধিকারের সুযোগ নেই। ফলে সেই রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া মদ রাখার সুযোগ নেই। অনুসন্ধান করে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা এই মদ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহিৃত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় এ ধরনের কার্য্ক্রম রাজস্ব ও অর্থনীতির উপর চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। একইসঙ্গে মদ চোরাচালানের বিষয়টি ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে।