শুভ্র শচীন, খুলনা: কায়িক পরীক্ষার নামে হয়রানি ও কাস্টমসের নানা অনিয়মের কারণে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঝামেলা এড়াতে আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দরমুখী হচ্ছেন। ফলে মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি কমছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ লাখ টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার পণ্য আমদানি হলেও মোংলা বন্দরে এ সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। প্রতিবছরই এ বন্দরে আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমছে।
জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোংলা বন্দর দিয়ে ৪৩ হাজার ৭ টিইইউ পণ্যভর্তি কনটেইনার আমদানি করা হয়। ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কনটেইনার আমদানি হয় যথাক্রমে ৪২ হাজার ১৩৭, ৪১ হাজার ৯৫৩ ও ২৬ হাজার ৯৫২ টিইইউ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র সাত হাজার ৪৮৯ টিইইউ কনটেইনার পণ্য আমদানি হয়েছে। আমদানির এ পতনের পেছনে কাস্টমসের অনিয়ম ও হয়রানিকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীই কেবল তাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন।
মোংলা কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শেখ লিয়াকত হোসেন অভিযোগ করে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মোংলায় পণ্য খালাসকরণে চার্জ বেশি। এ কারণে অনেক আমদানিকারকই বন্দরটি ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করছেন। এছাড়া আমদানি করা প্রতিটি পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় অনেক সময় লেগে যায়। এতে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়। এছাড়া যে ওয়েব্রিজে কনটেইনারের ওজন মাপা হয়, সেখানেও সঠিক মান পাওয়া যায় না। বলতে গেলে এখানকার সবখানেই ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
মোংলা বন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আহসান টিটো বলেন, আমদানি করা পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে প্রতিটি কনটেইনারের সব মালামাল ইয়ার্ডে বের করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়। এরপর সেগুলো কনটেইনারে ভরা হলেও পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে একাধিকবার বের করা হয়। এভাবে বারবার বের করার কারণে পণ্যের মান নষ্ট হয়। এছাড়া এতে ব্যবসায়ীদের খরচও বেড়ে যায়।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুলতান হোসেন খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাল্ক পণ্য আমদানিতে সামান্য কমবেশি হতেই পারে। এক্ষেত্রে মোট পণ্যে পাঁচ শতাংশ কমবেশি হওয়ার আন্তর্জাতিক নিয়ম রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে অতিরিক্ত পণ্যের ওপর ১০-২০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে পণ্য খালাসের বিধান রয়েছে। কিন্তু মোংলা কাস্টমসে ১০০-২০০ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। একই দেশের দুই বন্দরে তো আর দুই নীতি থাকতে পারে না। এভাবে চলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশনড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে দেশে আমদানি করা প্রায় ৭০ শতাংশ গাড়িই মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। দেখা গেছে, কাস্টমস থেকে পণ্য ছাড়করণের আগে প্রায়ই বন্দর থেকে আমদানি করা গাড়ির বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়। এ ধরনের অনিয়মের কারণে মোংলা বন্দর দিয়ে কনটেইনার ভর্তি পণ্য আমদানি আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
পাট রফতানিকারক সাইফুল ইসলাম পিয়াস জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ ফুট ড্রাফটের জাহাজ পণ্য খালাস করতে যে খরচ হয়, মোংলা বন্দরে তার চেয়ে এক লাখ টাকা বেশি লাগে। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে ব্যবসায়ীরা যে ফ্যাসিলিটি পান, তার বিন্দুমাত্র পাচ্ছেন না মোংলা বন্দর ব্যবহারকারীরা।
শিপিং এজেন্ট মো. বদিউজ্জামান টিটু বলেন, বন্দরের আমদানি-রফতানিকারকরা সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এ কারণে তারা চট্টগ্রামমুখী হচ্ছেন। সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ কর ছাড় দেওয়া হলে আমদানিকারকরা এটি ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। বন্দরের আমদানি বেড়ে যাবে। কার্যক্রমেও গতি আসবে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সম্পর্কে মোংলা কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার এনামুল হক বলেন, সংশ্লিষ্ট নিয়মনীতি ও রাজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী আমদানি পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রাজস্ব আদায় করা হয়। ঘোষণাবহিভর্‚ত ও অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করলে নির্দিষ্ট জরিমানা আদায় করা হয়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় অসৎ ব্যবসায়ীরা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি থেকে বিরত রয়েছেন। এ কারণে কনটেইনার আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কাস্টমসের হয়রানি ও অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। যেসব ব্যবসায়ী অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছেন না, তারাই মিথ্যাচার করছেন।
কাস্টম হাউজের কমিশনার মার্গুব আহমেদ বলেন, মোংলা বন্দরে কনটেইনারে করে আমদানি করা পণ্য পরীক্ষণের জন্য সংযোজন করা হচ্ছে একটি কনটেইনার স্ক্যানিং মেশিন। এরই মধ্যে মেশিনটি বন্দরের জেটিতে স্থাপন করা হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। এটি চালু হলে সেবার মান আরও উন্নত হবে।
Add Comment