মোংলা বন্দর ঘিরে অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনা

মো. আতিকুর রহমান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনের কোলঘেঁষে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মোংলা। দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অবদান রাখা বৃহত্তম এ বন্দরটি আগামী ১ ডিসেম্বর ৭২ বছরে পা দেবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য দেশে আনা এবং দেশ থেকে দ্রুত গন্তব্যস্থলে মালামাল পৌঁছে দেয়ার স্বর্ণদ্বার এ বন্দর।  ঐতিহ্যবাহী এ বন্দরটি একে একে পাড়ি দিতে যাচ্ছে ২৫,৯৩৪ দিন, ৬২২,৪১৬ ঘণ্টা এবং ৩৭০৪ সপ্তাহ।

১৯৫০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাট ও পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য বন্দর সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে চালনায় বন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে দাপ্তরিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয়। তার ১০ দিন পর থেকে জয়মনিরগোল নামক স্থানে ‘দ্য সিটি অব লিয়নস’ নামে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙরের মাধ্যমে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। ‘চালনা অ্যাংকোরেজ’ নাম পরিবর্তন করে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘মোংলা পোর্ট অথরিটি’ নামে নামকরণ করা হয়। বন্দর যখন চালনায় ছিল, তখন এটা ছিল একটা অচেনা গ্রাম। নাম ছিল শেলাবুনিয়া। তবে বন্দর স্থানান্তরের পরই ঘটে পরিবর্তন। একটা অচেনা ক্ষুদ্র গ্রাম পায় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। মোংলা নদীর তীরে স্থাপন হওয়ায় এ বন্দরের নাম হয় মোংলা। এ বন্দর প্রায় ৯৫০ হেক্টর জমির ওপর অবস্থিত ও মোংলা নদীর ৯০ শতাংশ জলসীমা এ বন্দর দখল করে আছে। পুরো অঞ্চল হচ্ছে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মোংলা বন্দর মূলত রপ্তানিনির্ভর বন্দর হিসেবে অত্মপ্রকাশ করে। পাট রপ্তানিই ছিল এ বন্দরের প্রধান কাজ। ২০০২ সাল থেকে এ বন্দর দিয়ে উল্লেখযোগ্য চিংড়ি মাছ রপ্তানি হচ্ছে।

চট্টগ্রাম আমাদের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং এর মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই পরিবহন করা হয়। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে, পণ্য খালাসে সময় বেশি লাগছে। তাই আমদানি-রপ্তানির জন্য মোংলা বন্দর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। আশার কথা, বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকার পর দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোংলা সমুদ্রবন্দরে রেকর্ডসংখ্যক ৯৭০টি জাহাজ এসেছে। এর আগে মোংলা বন্দরে এত জাহাজ আর কখনোই আসেনি। এই সময়ে মোংলা বন্দর ৩৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যা ছিল ৪১৬টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪৮২টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৬২৪টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৭৮৪টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৯১২টিতে। প্রায় সমপরিমাণ জাহাজ আগমন ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ বন্দরে জাহাজ আগমন হয় ৫১৯টি।      

পদ্মা সেতু চালু হলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য বদলে যাবে। এর ফলে মোংলা বন্দরের সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ণ সুবিধা সৃষ্টি হবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি করা পণ্য রাজধানীতে নিতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা থেকে ঢাকায় আমদানি করা পণ্য নিতে সময় লাগবে ৫-৬ ঘণ্টা। খান জাহান আলী বিমানবন্দর, খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মিত হলে মোংলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। বিনিয়োগকারীরা বিমানে করে মোংলা বন্দরে যেমন আসতে পারবে, তেমনি অপর সৌন্দর্যে ভরপুর সুন্দরবন দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসতে পারবেন। রেল যোগাযোগের মাধ্যমে মোংলা বন্দর থেকে সারাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আদালতের মামলায় বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির ফলে নীল অর্থনীতির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করতে হলে মংলা বন্দরের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ করতে হবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর হলে তার সংযোগ ও সুফল পাবে মোংলা বন্দর। এছাড়া পায়রা পাওয়ার প্লান্ট ও পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেললাইন স্থাপনের ফলে  মোংলা বন্দরের সঙ্গে কর্মকাণ্ড অবশ্যই বাড়বে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে, প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পকে ভবিষ্যতে খুলনা ও মোংলা বন্দর এলাকায় সম্প্রসারণ করতে পারলে ভিন্নমাত্রা যোগ হতে পারে। খুলনা ও রাজশাহীগামী পরিবহন ও যানবাহন মোংলা বন্দর থেকে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। যারা এখন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে, মোংলা বন্দর হবে তাদের জন্য অনেক সহজ এবং ভালো বিকল্প ব্যবস্থা।

এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মোংলা বন্দর বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভারত ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি মোংলা ও কলকাতার হলদিয়া বন্দরের মধ্যে জাহাজ চলাচল বাড়লে বা ট্রানজিট সম্প্রসারণ হলে মোংলা বন্দর অনেক বেশি অবদান রাখবে। নেপাল ও ভুটানের আমাদের মোংলা বন্দর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এবং তাদের লাভ হয় এমন পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্দর ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে, যাতে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে তাদের পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। চট্টগ্রাম জেটি থেকে বঙ্গোপসাগর মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে কিন্তু মোংলা থেকে অনেক বেশি। চট্টগ্রামে নদীর গভীরতা বেশি, যা ৯ দশমিক ১৫ মিটার অবধি জাহাজকে বার্থিং সুবিধা দিতে পারে; কিন্তু মোংলা মাত্র ছয় মিটার গভীরতাসম্পন্ন জাহাজকে বার্থিং সুবিধা দিতে পারে। ফলে ১ হাজার ২০০ টিইইউএসসম্পন্ন জাহাজকে বার্থিং দিতে মোংলা বন্দর সক্ষম হয় না; প্রাকৃতিক কারণে তার এ অপারগতা।

এছাড়া মোংলা বন্দরকে অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর আকর্ষণীয় করতে হলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ড্রেজিং বাবদ ব্যয় কমাতে হবে এবং পোর্টের সুবিধা বাড়াতে হবে। এখন প্রায় ৩৩টি জাহাজ একসঙ্গে বার্থিং বা খালাসের জন্য সুযোগ দিতে পারে এবং ২২৫ মিটার দীর্ঘ জাহাজও ঢুকতে পারে। মোট ১১টি জেটি, আটটি ওয়্যারহাউস ও ১২টি সুইং মুরিং এলাকায় জাহাজ অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু সক্ষমতা আরও বাড়াতে না পারলে আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রবন্দর হিসেবে চিহ্নিত হতে পারবে না।

বর্তমানে মোংলা বন্দরকে আধুনিক করার লক্ষ্যে অনেক উন্নয়ন ও বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় হাতে নিয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্দর এলাকাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বে রো-রো ফেরি প্রতিস্থাপনসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে জাহাজের খালাসের সময় কমানোর প্রতিযোগিতা চলছে। মোংলা বন্দর ঘিরে এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করতে হবে।

এক সময়ের রুগ্ণ মোংলা বন্দর এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে মোংলার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে এ বন্দরে জাহাজ আসে। সিঙ্গাপুর-কলম্বো-হংকং হয়ে বেশিরভাগ জাহাজ মোংলায় আসে। বাংলাদেশের প্রায় সব নদী-বন্দরগুলোর সঙ্গে মোংলার সংযুক্তি যেমন রয়েছে, তেমনি উপকূলীয় জাহাজ চুক্তির মাধ্যমে কলকাতা বন্দর এবং থাইল্যান্ডও মোংলার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে, যা মোংলাকে আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। 

পৃথিবীর প্রায় সব বন্দরের সঙ্গেই মোংলা বন্দরের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। মোংলা বন্দরকে ঘিরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভর করছে। খান জাহান আলী বিমানবন্দর, পদ্মা সেতুর ওপর রেললাইন মোংলা বন্দরকে সংযোগ করা এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক অঙ্গনে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। ফলে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে সাফল্য আসবে।

মুক্ত লেখক

onatiq88@yahoo.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০