Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:21 pm

মোজাম্বিক ইথিওপিয়া কম্বোডিয়ার চেয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশ

ইসমাইল আলী: নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস বলেছিলেন, শুধু সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল থাকলেই যে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণ করা যাবে এটি সঠিক নয়। দেশের পরিকাঠামো ও পরিবেশ বিনিয়োগযোগ্য হতে হবে। সবার ওপরে দরকার আর্থিক নীতির নির্ভরতা। তাহলেই বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। একটি বিদেশি কোম্পানি ভালো ব্যবসা করলে অন্যদের কাছে তার খবর পৌঁছে যায়। আর এতেই বিদেশি বিনিয়োগ আসাটা ক্রমে সহজ হয়ে যায়। সে উক্তিটি আবারও সত্য প্রমাণিত হলো।

জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২২’ প্রতিবেদন বলছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে তাই এফডিআই প্রবাহে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে আঙ্কটাড।

এফডিআই প্রবাহে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে আফ্রিকান দেশ মোজাম্বিক। ২০২১ সালে দেশটিতে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল পাঁচ দশমিক ১০২ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের আরেক দেশ ইথিওপিয়া। দেশটিতে গত বছর এফডিআই প্রবাহ ছিল চার দশমিক ২৫৯ বিলিয়ন ডলার। আর এফডিআই প্রবাহে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া। দেশটিতে গত বছর এফডিআই প্রবাহ ছিল তিন দশমিক ৪৮৪ বিলিয়ন ডলার।

চতুর্থ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে ২০২১ সালে এফডিআই আসে দুই দশমিক ৮৯৬ বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তিন দশমিক ৬১৩ বিলিয়ন ডলার এফডিআই আসে। এছাড়া গত বছর ২ দশমিক ২৩২ বিলিয়ন ডলার এফডিআই নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার আরেক দেশ সেনেগাল।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। যদিও আগের দুই বছর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কমেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে এফডিআই কমে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও ২০১৯ সালে কমেছিল রেকর্ড ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ওই দুই বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ ছিল যথাক্রমে দুই দশমিক ৫৬৪ বিলিয়ন ডলার ও দুই দশমিক ৮৭৪ বিলিয়ন ডলার।

এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনও আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য দুই বা আড়াই বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। তবে এক্ষেত্রে আফ্রিকান যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে তাদের অর্থনীতির প্রকৃতি ভিন্ন ধারার। দেশগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ। পাশাপাশি কৃষিতে বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে দেশগুলোর। এজন্য এসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বেশি। বাংলাদেশে ওই খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে। তবে এ খাতে প্রতিদ্ব›িদ্বতা অনেক বেশি। আর অবকাঠামোগত দুর্বলতায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এজন্য আশানুরূপ বিনিয়োগ এ খাতে আসছে না।

আঙ্কটাডের তথ্যমতে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহে দক্ষিণ এশিয়ায় বরাবরের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে শীর্ষ থাকা ভারতে গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল ৪৪ দশমিক ৭৩৫ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানে দুই দশমিক ১০২ বিলিয়ন ডলার এফডিআই যায়। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় গেছে ৫৯৪ মিলিয়ন ডলার। আর প্রতিবেশী আরেক দেশ মিয়ানমার গত বছর এফডিআই পেয়েছে দুই দশমিক ০৬৭ বিলিয়ন ডলার।

গত বছর বিশ্বব্যাপী মোট বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ছিল প্রায় ১ দশমিক ৫৮ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলার। ২০২০ সালের তুলনায় যা ৬১৯ বিলিয়ন ডলার বা ৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ ছিল ৯৬৩ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ ছিল এক দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ করোনার প্রকোপে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহে যে ধস নেমেছিল তা গত বছর পুষিয়ে নিয়েছে বিশ্ব।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আঙ্কটাড বলছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে করোনার প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বাংলাদেশ। তবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়া তিনগুণ তথা ১৪টিতে উপনীত হয়েছে। এগুলোয় বিনিয়োগ হওয়ার কথা চার দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আনন্দ বাজারে একটি কনটেইনার টার্মিনাল হওয়ার কথা যেখানে দুই বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশে এফডিআই স্টক বাড়ছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের আন্তঃপ্রবাহ স্টক ছিল ২ দশমিক ১৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ০৭২ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছর তা আরও বেড়ে ২১ দশমিক ৫৮২ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ স্টক বাড়ছে, এতে খুশির কিছু নেই। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেই যে দারিদ্র্য কমবে কিংবা কর্মসংস্থান তৈরি হবে এমন কোনো কথা নেই। বিনিয়োগ যেটা হচ্ছে, তা কোন কোন খাতে, সেটা দেখার আছে। সামনেও হয়তো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু এতে মানুষের জীবনমানের কতটা উন্নতি হচ্ছে, দারিদ্র্য পকেটগুলো থেকে মানুষকে বের করে আনা যাচ্ছে কি না, প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হচ্ছে, এ বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।