মোট খেলাপির ৮৭ শতাংশই মন্দঋণ

জয়নাল আবেদিন: ক্রমেই বড় হচ্ছে ব্যাংক খাতের বিষফোঁড়া নামে পরিচিত কু-ঋণের (ব্যাড লোন) অঙ্ক। খেলাপির প্রকারগুলোর মধ্যে ব্যাড লোনের সংখ্যাটাই সবচেয়ে বড়। বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৭ শতাংশই মন্দ মানের। এর পরিমাণ ৮৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে মন্দঋণ বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকারদের কাছে মন্দ মানের ঋণগুলো আদায় অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া নি¤œমান ও সন্দেহজনক ঋণগুলো আদায়ের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ নিয়মাচার ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সর্বোত্তম পরিপালন না করে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করায় ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে একটা সময় আদায় অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালন আয় কমে নিট মুনাফায় প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হলোÑনি¤œমান, সন্দেহজনক ও মন্দ মান। অর্থাৎ সর্বশেষ ধাপের খেলাপি ঋণকে মন্দ বা ক্ষতিজনক বলে ধরা হয়। এটা ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত। এজন্য এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। অন্য দুটি পর্যায়ের মধ্যে সন্দেহজনক ঋণে ৫০ শতাংশ ও নি¤œমানের ঋণে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকারদের মতে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, তদবির ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে। এখন ওইসব ঋণের একটা বড় অংশ খেলাপি হয়ে মন্দ মানে পরিণত হয়েছে।

মহামারি করোনার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ায় মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকায় নেমে আসে। জুন প্রান্তিকে আবার খেলাপি ঋণ প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৩ হাজার ৬৪২ কোটি টাকাই মন্দ মানের, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ৯৪ হাজার ৩১২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ ছিল ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। ফলে গত ছয় মাসের ব্যবধানে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্দ মানের খেলাপি ঋণের ৪৩ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকাই সরকারি ব্যাংকের, যা মোট মন্দ ঋণের ৫২ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। এরপরেই রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। মোট মন্দ ঋণের ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। অঙ্কের বিবেচনায় যার পরিমাণ ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি ২৪ লাখ। এ ছাড়া বিদেশি আট ব্যাংকের এক হাজার ৯২৬ কোটি টাকা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে; যা মোট মন্দঋণের ২ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, মন্দঋণ একদিনে তৈরি হয় না। প্রথমে নিন্মমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড তারপর সন্দেহজনক বা ডাউটফুল এবং সবশেষে ব্যাড লোন বা মন্দঋণে পরিণত হয়। যখন কোনো গ্রাহক টাকা ফেরত দিতে চায় না এবং ব্যাংক সেই টাকা এক বছরের বেশি সময় ধরে আদায় করতে ব্যর্থ তখন সেটা মন্দঋণে পরিণত হয়।

তিনি বলেন, এই টাকা ফেরত পেতে ব্যাংকের সব রকম প্রচেষ্টা থাকতে হয়। এসব প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে প্রথম হলো ব্যাংকের আইনি কাঠামো শক্ত করা। আমাদের দেশের আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে খুব সহজেই অপরাধীরা বেরিয়ে যেতে পারে। সেই সুযোগে খেলাপিরা দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, বিদেশে বাড়ি  তৈরি করছে, বাড়ি বানাচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যাংকের ছোট গ্রাহকরা। এই সমস্যা সমাধানে ছোট-বড় সব ধরনের কাস্টমারের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ বিতরণের আগে একাধিকবার যাচাই-বাছাই করতে হবে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো ব্যাংকের পর্ষদ, ম্যানেজমেন্ট ও সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন। যোটাকে বলা হয় করপোরেট গভর্ন্যান্স। এ টাকা থাকলে ব্যাংক খাতের খেলাপি এমনিতেই কমে আসবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০