মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি

রোকাইয়া আক্তার তিথি: বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের বহুল ব্যবহার ব্যক্তির মানসিক অবক্ষয়ে পালন করছে সক্রিয় ভূমিকা। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে হচ্ছে বাধার কারণ। কভিডকালে বেড়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা। শুধু শিশু-কিশোর নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও বৃদ্ধি পাচ্ছে মোবাইল ফোনের আসক্তি, তাদের এই আসক্তির জন্যে অনেক সময় সৃষ্টি হচ্ছে বৈবাহিক কলহ, মানসিক অবনতি ও বিভিন্ন রোগের সূচনা। গ্রামাঞ্চলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক ও লাইকি ভিডিও দেখার আগ্রহ তীব্র। বাবা-মায়েরা সন্তানদের শান্ত রাখার জন্যে ফোন দিয়ে তাদের বসিয়ে রাখছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলস্বরূপ তাদের মস্তিষ্কের গঠনে পড়ছে প্রভাব, বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা।

অভিভাবকরা এসব ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরও তাদের সচেতনতামূলক ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায় না। বরং তারা তাদের সন্তান বা পোষ্যকে ফোন ব্যবহার ও গেম খেলতে দিচ্ছে না কোনো বাধা, তাদের ব্যস্ত রাখতে চালিয়ে যাচ্ছে এই বৃথা প্রচেষ্টা, যা তাদের সমূহ ক্ষতির কারণ। করোনা মহামারিকালে স্মার্টফোনের ব্যবহার নিশ্চিত করেছে প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী, যা তাদের জন্যে সুফল বয়ে আনলেও কুফল ঘটেছে অনেকটাই। যারা অনলাইনে ক্লাস করতে মোবাইল ফোন হাতে নিয়েছে, একপর্যায়ে সেই ফোনে তারা পড়াশোনার বদলে গেম বা ইন্টারনেটভিত্তিক ক্ষতিকর অ্যাপগুলোয় আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকেই চলে গেছে বিপথে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরেও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের আসক্তি। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে তারা প্রবেশ করছে বিভিন্ন সাইটে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত করছে ভিডিও দেখে ও গেম খেলে। তারা দিনে ছয় থেকে ১০ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় স্মার্টফোনের পেছনে ব্যয় করছে। এতে তৈরি হচ্ছে বিষণœতা, ক্ষুধামান্দ্য ও অবসাদ।

শিক্ষার্থীদের অনলাইন আসক্তির কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায়। পোল্যান্ডভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের পরিসংখ্যান বলছে, করোনা পরিস্থিতির আগে যেখানে বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার, ২০২১ সালের মে মাসে তা দাঁড়ায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজারে। তাদের মধ্যে দুই কোটি ১২ লাখের বয়সই ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। একই সঙ্গে বেড়েছে মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, লাইকি ও বিগোর মতো হালের আলোচিত অ্যাপসের ব্যবহার।

২০২১ সালের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড (আইএসপি ও পিএসটিএন) ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা মাত্র ৯৮ লাখ ১০ হাজার। বাকি ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে তীব্র ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা। দীর্ঘ সময় তারা ব্যয় করছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের এই প্রবণতা থেকে তারা সময় দিচ্ছেন না তাদের সন্তানদের। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক একটি সংস্থা এক হাজার মা-বাবা এবং তাদের সন্তানের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয়, যেখানে প্রতি ১০ জনে ছয়জন মা-বাবা মনে করেন, তাদের সন্তান মোবাইল ফোনে আসক্ত, সেখানে প্রতি ১০ জনে চারজন সন্তান মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। জরিপে অংশ নেয়া ৩৮ শতাংশ কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। এমনকি ৪৫ শতাংশ মা-বাবা নিজেরাই মনে করেন তারা মোবাইলে আসক্ত।

প্রতিনিয়ত বাড়ছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। দুই মিনিট স্থায়ী একটি ফোনকল শিশুদের মস্তিষ্কে হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে।

হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রক্তের চাপ বেড়ে যায়। দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে; এমনকি নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। স্মার্টফোনের স্ক্রিনের রেডিয়েশন প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শিশুদের জন্য তা আরও বেশি ক্ষতিকর। এটি তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে। মস্তিষ্কের ক্যানসার এ মোবাইল ফোন একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় রশ্মি আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলতে পারে। মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট বেতার তরঙ্গ আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উত্তপ্ত করে তোলে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তরঙ্গকে কারসিনোজেনিক বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী বলে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়াসহ চোখের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যাবহারের ফলে।

প্রত্যেক পরিবারের উচিত শিশু-কিশোরদের বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা, বাইরে খেলধুলা করার জন্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং পরিবারের সবাইকে সময় দেয়া। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, তারা যেন নিজেরাও স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি সচেতন হোন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল ও আসক্তি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবগত করা। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ভয়াবহ আসক্তি থেকে নতুন প্রজš§কে রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য প্রতিটি ব্যক্তির নতুন সমাজ গঠন করার আকাক্সক্ষা থাকতে হবে, যেখানে শিশুদের ফোনে নিমগ্ন না রেখে মুক্ত বাতাসে খেলতে আগ্রহী করা যায়। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বই পড়ার চর্চা তৈরি করতে হবে। সবার সক্রিয় প্রচেষ্টাই পারে জাতিকে মোবাইল ও ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার আর আসক্তি থেকে মুক্ত করতে।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০