মোর মেয়েকে লইয়্যা মুই কি খাইমু, কিভাবে পড়াইমু: শিউলী আফরোজ

প্রতিনিধি , বরিশাল: মোর মেয়েকে লইয়্যা মুই এহন কিভাবে বাঁচমু। কেডা মোর মেয়েকে দেখবে ও লেখাপড়া করাইবে। বিয়ার পর মোরে লইয়্যা ঢাকায় যাইয়া কত কষ্ট করেছে, কষ্ট কইরা মেয়েকে পড়াশোনা করাইয়া মেট্রিক পাশ করাইছে। বিদেশে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই আল্লা অরে (স্বামী) লইয়া গেল। মোগো মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। কি কইরা মুই ধারদেনার সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিমু। মোর মেয়েকে লইয়্যা মুই কি খাইমু, মেয়েকে কিভাবে পড়াইমু, আল্লাহ কিভাবে বাঁচমু?

বিলাপ করে কথাগুলো বলেছেন- কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বরিশালের গৌরনদীর শরিকল ইউনিয়নের পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের রংমিস্ত্রি জামাল হোসেন শিকদারের বিধবা স্ত্রী শিউলী আফরোজ (৩৭)।

বিদেশে যাওয়ার জন্য কেনাকাটা করতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম (চিটাগাং রোডে) মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন সাইনবোর্ড এলাকায় গত ২০ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে জামাল হোসেন শিকদার (৪০) মারা যান।

গত ২২ বছর ধরে ঢাকা মহানগরীর রায়েরবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে জামাল। রংমিস্ত্রির কাজ করে অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল ভূমিহীন দরিদ্র জামাল হোসেন শিকদারের পরিবারটি। ২১ জুলাই ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে পূর্ব হোসনাবাদ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্থানে জামালের লাশ দাফন করা হয়।

নিহত জামাল ওই গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মরহুম মহসিন হোসেন শিকদার ও মরহুম ছালেহা বেগমের ছোট ছেলে। ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে জামাল ছিল সবার ছোট।

গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জামালের বিধবা স্ত্রী শিউলী আফরোজ বলেন, বিয়ের পর ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমার স্বামী আমাকে সঙ্গে করে ঢাকা মহানগরীর রায়েরবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। রংমিস্ত্রির কাজ করে আসছিল। আমাদের তিন সদস্য পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী জামালের আয় দিয়েই অর্ধাহারে-অনাহারে আমাদের সংসার চলছিল। সৌদি যাওয়ার জন্য গত ৩ মাস পূর্বে স্বামী জামাল হোসেন শিকদার ধারদেনা ও ঋণ করে সৌদি প্রবাসী মো. রনজু মিয়াকে নগদ সাড়ে ৫ লাখ টাকা দেয়। ২৭ জুলাই স্বামী জামালের সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের একমাত্র মেয়ে নুজহাত হোসেন জিতুকে (১৬) গত ১৬ জুলাই ঝিকাতলা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রব পাবলিক কলেজে ভর্তি করাই। ওই দিন বিকালে আমরা তিনজনে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিটাগাং রোডে পাইনাদি নতুন মহল্লায় এলাকায় সহোদর বোন আখিনুর বেগম ও ভাই তাওহীদ চৌধুরীর বাসায় বেড়াতে যাই।

সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লার ভাড়াটিয়া নিহতের শ্যালক তাওহীদ চৌধুরী বলেন, সৌদি আরবে নিতে চিটাগাং রোডে সাইনবোর্ড এলাকায় আহসানউল্লাহ সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করার জন্য ২০ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পাইনাদি নতুন মহল্লার আমার ভাড়াটিয়া বাসা থেকে আমি ও আমার দুলাভাই (ভগিনীপতি) জামাল হোসেন বের হই। বিকাল ৫টার দিকে সাইনবোড এলাকার আহ্সানউল্লা সুপার মার্কেটের কাছে পৌঁছেলে। এ সময় ওই এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে ও ডাচবাংলা ব্যাংকের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করত দেখি একদল পুলিশকে। তখন আমি ও দুলাভাই দৌড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টাকালে একটি গুলি এসে দুলাভাই জামাল হোসেনের বাম পায়ের উরুতে (কোমরের একটু নিচে) বিদ্ধ হয়। তখন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মারাত্মক জখম অবস্থায় দুলাভাইকে খানপুর সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অপারেশন করে গুলি বের করা লাগবে বলে জানায়। অপারেশনের ডাক্তার উপস্থিত নেই বলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকা মেডিকেল নেওয়ার পথিমধ্যে দুলাভাই জ্ঞান হারিয়ে ফেললে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শান্তিনগর অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পোস্টমর্টেম ছাড়াই জামালের লাশ গ্রহণ করে রাত ৯টার দিকে রায়েরবাজার এলাকায় নিয়ে আসি। এর পর সেখান থেকে স্বজনরা ওই দিন রাতেই গ্রামের বাড়ি পূর্ব-হোসনাবাদ গ্রামের এনে ২১ জুলাই ভোর সাড়ে ৩টার দিকে জামালের লাশ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজের উদ্দেশ্যে এক সপ্তাহ পরই সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল জামাল শিকদারের। সেজন্য পরিবারের চলছিল শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। উপার্জনক্ষম জামাল হোসেনের মৃত্যুতে তার পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। এমন মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে নিহতের স্বজনরা।

এদিকে জামালের বড় ভাই জাকির হোসেন রোকন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ বছর আগ মারা গেছেন।

আড়িয়াল খাঁর শাখা পালরদী নদীর ভাঙনে জামালদের পৈতৃক ভিটাবাড়ি ও আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। গত ১০ বছর পূর্বে তার পিতা মহাসিন হোসেন শিকদার মারা যাওয়ার সময় মাত্র ২ শতাংশ ভিটা বাড়ি রেখে গেছেন। তাদের পৈতৃক ভিটায় কোনো ঘর নেই। তাই তাদের মাথা গোজার ঠাঁইও নেই।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০