মৌলভিত্তির কোম্পানিতেই ভরসা বিনিয়োগকারীদের

শেখ আবু তালেব: বেশি ঝুঁকির জাঙ্ক শেয়ার পুরো পুঁজিবাজারকেই উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার। এবারও জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ছোট পুঁজির ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীই সিংহভাগ। এ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌলভিত্তির শেয়ারে এবার খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কেউ। যেটুকু হয়েছে তাও পুষিয়ে নেয়া যাবে।

এভাবে জাঙ্ক থেকে মৌলভিত্তির শেয়ারের প্রতি এরই মধ্যে ঝুঁকে পড়েছেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। এদিকে মৌলভিত্তির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত সপ্তাহে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ডিএস৩০ সূচকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মোট শেয়ারের সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয় করতে পারত। এর বেশি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা এখন তুলে দিয়েছে বিএসইসি। ফলে এখন থেকে আগের চেয়ে বেশি শেয়ার ক্রয় করতে পারবে আইসিবি।

বতর্মানে এই সূচকে ৩০টি কোম্পানি রয়েছে। যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং শেয়ার লেনদেনকৃত অর্থেও পরিমাণ প্রতি তিন মাসের গড়ে দৈনিক ভিত্তিতে ৫০ লাখ টাকা করে হবে। এজন্য প্রতি তিন মাস অন্তর এ তালিকা পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। বর্তমানে এ সূচকে ৩০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়। এসব কোম্পানিই মৌলভিত্তির।

দেখা গেছে, বর্তমানে এ তালিকায় রয়েছে বিএটিবিসি, বিবিএস কেব্লস, বিকন ফার্মা, বেক্সিমকো, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসসিসিএল, বিএসআরএম লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, সিটি ব্যাংক ও ফরচুন শুজের মতো কোম্পিানি। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কের জš§ দিয়েছে ফরচুন শুজ। এক বছর আগে শেয়ারটির দর ছিল ১৯ টাকা ৪০ পয়সা। কোনো কারণ ছাড়াই শেয়ারটির দর হু-হু করে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে শেয়ারটির দর ১৪২ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে দর পতনের বাজারে এ শেয়ারটির দরও কমে যায়। সর্বশেষ শেয়ারটি ১২১ টাকায় লেনদেন হয়। শেয়ারটির এমন অস্বাভাবিক শেয়ারের দর নিয়ে বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএসই কয়েকবার তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়। প্রতিবারই ফরচুন শুজের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই কোম্পানির কাছে।

অথচ তারপরও শেয়ারটির দরে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। ২০২১ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এর আগের বছর ২০২০ সালে দিয়েছিল পাঁচ শতাংশ বোনাস ও পাঁচ শতাংশ নগদ। আর ২০১৯ সালে দিয়েছিল ২০০ শতাংশ নগদ ও ১৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। কিন্তু ওই বছরটিতেও কোম্পানিটির শেয়ারের দর এত বৃদ্ধি পায়নি। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারদরের এ কোম্পানিতে কারসাজি চক্রের উপস্থিতির বিষয়টি এখন বাজারে ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে।

আবার মৌভিত্তির বিকন ফার্মার শেয়ারটি এক বছর আগে লেনদেন হয়েছে ১২৮ টাকায়। সেই শেয়ারটির এখন ৩০০ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। এ শেয়ারে বিনিয়োগ করে লভ্যাংশের পাশাপাশি শেয়ারের বাজারমূল্য বিবেচনায়ও বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। একইভাবে বিবিএস কেব্লস, বেক্সিমকো, বিএসআরএম লিমিটেড, ডেল্টা লাইফ ও ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। মৌলভিত্তির এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এখনও কয়েকগুণ বেশি মুনাফায় রয়েছেন। যদিও এই সময়ে সূচকের পতন হয়েছে, অধিকাংশ শেয়ারের দর পতন হয়েছে। বাজারের সব সূচকের পতনের চাপ সামলিয়ে লাভের মুখ দেখাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের এসব শেয়ার। এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে হতাশ হতে হয়নি বিনিয়োগকারীদের।

এদিকে তালিকায় থাকা অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারের দরে খুব একটা লোকসান দেখা দেয়নি। ওষুধ খাতের স্কয়ার ফার্মার শেয়ারদর এক বছর আগে ছিল ১৯৫ টাকা। করোনা মহামারি সংক্রমণের সর্বোচ্চ সময়ে ওষুধের চাহিদা বেশি থাকায় কোম্পানিটি সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে। এতে মুনাফা যোগ হয়। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ারে আকৃষ্ট হন বিনিয়োগকারীরা। একপর্যায়ে ব্যাংকটির শেয়ারের দর সর্বোচ্চ ২৫২ টাকায় ওঠে। এরপর ফের পতন হতে থাকলে বর্তমানে ১৬৯ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর দরপতনের কারণ হচ্ছে বাজারের সার্বিক পতনের চাপ। সাময়িক সময়ের মধ্যেই শেয়ারটির দর আরও ভালো অবস্থানে যাবে, যার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।

আবার ‘জেড’ ও বিতর্কিত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে লোকসান দেখছেন অধিকাংশই। এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জাঙ্ক শেয়ারে বিনিয়োগ করা ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর সংখ্যাই বেশি। এতে লাভবান হওয়া যায় না। যারা বিনিযোগ করে বাজারকে অস্থিতিশীল করেছিল, তারাই এখন ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কারণে এখন পুরো বাজার নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। এখন একমাত্র বিনিয়োগের ভরসার জায়গা হলো মৌলভিত্তির ভালো মানের শেয়ার। এখনে বিনিয়োগে ঝুঁকি খুব একটা নেই।’

উচ্চ ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা পরিহার করে অপেক্ষকৃত কম ঝুঁকির শেয়ারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছেন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিএসই-ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘অতি লোভে পড়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জায়গা। এখানে শর্ট টাইমে লাভবান হতে গেলেই ঝুঁকিতে পড়তে হয়। এতে অন্য কেউ লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশিরভাগ। বিশেষ করে ছোট পুঁজির ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। কারণ তারা দক্ষ নন। প্রলোভনে পড়ে ঋণ পর্যন্ত নেন। যখন বাজার পড়ে যায়, তখন ঋণের সুদ ও পুঁজি সামলাতে গিয়ে শেয়ার বেচে দেন। এতে শেয়ার বিক্রয় প্রেশার বেড়ে গিয়ে বাজারকেই অস্থিতিশীল করে দেয়। এজন্য তাদেও সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কষ্টের টাকা নয়, অলস বা কোথাও বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না, এমন অর্থই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত বলেও মনে করেন এই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কর্মকর্তা।’

একইসঙ্গে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন না। এজন্য মৌলভিত্তির ও ভালো মানের শেয়ারেই বিনিয়োগ করতে হয় সবার। আন্তর্জাতিক বাজারগুলোতেই তাই দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে বিনিয়োগের চেয়ে ট্রেডিংয়ে বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা, যা শুভকর নয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০