মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় রেণু ও পোনা বিক্রির ভরা মৌসুম। এপ্রিল-মে মাসও পার হয়ে শুরু হয়েছে জুন। মৌসুম শেষ হতে চললেও এখনও জমেনি যশোরের চাঁচড়া রেণু ও পোনার বাজারটি। বিক্রি নেই বললে চলে, চরম দুর্দিন যাচ্ছে এখন যশোরের মাছচাষিদের। সেই সঙ্গে মৎস্য খাবারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন যশোরের হ্যাচারি মালিক ও ক্ষুদ্র মাছচাষিরা। ভরা মৌসুমে ক্রেতার অভাবে খাঁ খাঁ করছে বাজারটি।
হ্যাচারি মালিকরা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চ মাসে পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বৈশিক করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়েন এ অঞ্চলের মাছচাষিরা। টানা প্রায় ৬ মাস করোনার ভয়াবহতার কারণে মাছ উৎপাদন ও বিক্রি কার্যত থমকে যায় এ অঞ্চলের হ্যাচারিগুলো। বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার মাছচাষি। বন্ধ হয়ে যায় জেলার ৪২টি হ্যাচারি। এরপর করোনা পরিস্থিতি কিছুটা কম হওয়ার পর হ্যাচারি মালিক ও মাছচাষিরা আবার পুরোদমে মাছ চাষ শুরু করেন। চলতি মৌসুমে চাঁচড়া থেকেই কয়েক কোটি টাকার রেণু ও পোনা বিক্রির আশা ছিল তাদের। কিন্তু এ বছর মাছের রেণু ও পোনা বিক্রির উপযুক্ত সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না পাওয়ায় এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি মাছের রেণু ও পোনা বিক্রি।
জেলা মৎস্য বিভাগের সূত্রে জানাগেছে, শুধু যশোর জেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ সরাসরি মাছ চাষে নিয়োজিত। এ জেলায় ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুর রয়েছে। বাঁওড় রয়েছে ১৩ হাজার ৩৯১ হেক্টর। আর জেলাজুড়ে হ্যাচারির সংখ্যা ৫২টি। এসব খামারে বছরে রেণু উৎপাদন হয় ৫৪ হাজার ২০০ কেজি, যা থেকে পোনা উৎপাদন হয় প্রায় ৪৮ কোটি ৩৭ লাখ। কিন্তু এ বছর পানির অভাবে রেণু পোনা বা চারা মাছ বিক্রয়ে ধস নামায় এ বছর লাভতো দূরের কথা পুঁজিও রক্ষা করতে পারছেন না মাছচাষিরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছ চাষের রাজধানী হিসেবে খ্যাত যশোরে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন কমে যেতে পারে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা হ্যাচারি মালিক ও মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, যশোরের মাছচাষিদের চরম দুর্দিন যাচ্ছে এখন। এক দিকে করোনার কারণে মাছের ব্যবসায়ে আমরা গত কয়েক বছর ধরে ক্ষতির মুখে রয়েছি। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেনের বড় প্রভাব পড়েছে এ খাতের ওপর। মাছের খাবারসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। অথচ মাছের রেণু ও পোনার দাম যেমন নেই তেমনি বিক্রিও নেই। তিনি বলেন, মার্চের মাঝামাঝি সময়ে রেণু ও পোনা বিক্রির ভরা মৌসুম হলেও এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে রেণু ও পোনা বিক্রি নেই বললে চলে। যা বিক্রি হচ্ছে তাও কম দামে। এতে আমরা পুঁজি রক্ষা করতে পারছি না।
প্রায় একই কথা বলেন, সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য যশোরের মাছ চাষ বড় ধরনের ভ‚মিকা রেখে আসছে। প্রতি বছর এই সময়ে আমাদের বাজার ও হ্যাচারিগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। তবে এ বছর মৌসুম শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত পোনা ও রেণু বিক্রি করতে পারছি না আমরা। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যেসব চাষি আমাদের এখানে মাছের রেণু ও পোনা কিনতে আসেন তারা সবাই বৃষ্টির অপেক্ষায় আছেন। বর্তমান যে বৃষ্টি হচ্ছে তা মোটেও পর্যাপ্ত না। ভারী বৃষ্টি না হলে ক্রেতারা আসবেন না। এ অবস্থা বেশি বিলম্বিত হলে আমাদের পথে বসতে হবে বলে তিনি জানান।
গতকাল চাঁচড়ার বাবলাতলা মোড়ে পোনা বিক্রির বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক খুচরা মাছ ব্যবসায়ী মাছের বিভিন্ন জাতের পোনা নিয়ে বসে আছেন। অন্যান্য দিনে বাজারটিতে ক্রেতাদের যেমন ভিড় থাকলেও গতকাল ছিল ভিন্ন চিত্র। বাজারে কথা হয় মাছের পোনা বিক্রেতা রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর ধরে এ বাজারে পোনা বিক্রি করে আসছি। কিন্তু এ বছরের মতো খারাপ অবস্থা দেখিনি। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব। এসব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যে পাইকাররা এ বাজারে আসত তারা এখন পর্যন্ত সাড়া দিচ্ছে না। এতে করে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছের পোনা বিক্রি করতে পারছি না। তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে মাছচাষির সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।