২০ মার্চ ২০১৯ম্যানিয়াংপাড়া, আলীকদম, বান্দরবান
ম্যানিয়াংপাড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় সাড়ে ৯টা বেজে গেল। পাঠক, গত পর্বে জেনেছেন, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার মুরং জনগোষ্ঠীর একটি গ্রাম এ ম্যানিয়াংপাড়া। পাঁচ পরিবারের ছোট্ট, ছিমছাম ও ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম এটি। পাহাড় বেয়ে আমরা যখন গ্রামের কাছে এসে দাঁড়ালাম, আমাদের কারোই শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। ম্যানকিউপাড়া থেকে ম্যানিয়াংপাড়া আসতে আমাদের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে! আমার মাসল ক্রাম্প করায় প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল প্রচণ্ড ব্যথার। তবে পাহাড়ের ওপর থেকে ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর ম্যানিয়াংপাড়া দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছিল এক কল্পনার জগতে এসে পৌঁছেছি।
গাইড ল্যাং মুরং আমাদের সরাসরি নিয়ে গেলেন ম্যানিয়াংপাড়ার কারবারি ম্যানিয়াং মুরংয়ের ঘরে। ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে পিঠের ব্যাগ নামিয়ে রেখে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এরপর ল্যাং বললেন, চলুন, হাত-মুখ ধুয়ে আসি ছড়া থেকে, ভালো লাগবে।
বের হয়ে হাত-মুখ পরিষ্কারের জায়গা দেখে তো আমাদের একেকজনের হার্টবিট বেড়ে যায়। ছড়ায় যেতে আবারও ৮০ থেকে ৯০ ফুট নিচে নামতে হবে। যাহোক, বাধ্য হয়ে আবার নিচে নামা শুরু করলাম। নিচে যে আমাদের জন্য আরেকটি বিস্ময় অপেক্ষা করছিলÑতা কে জানত? টিনের চালা দেওয়া লম্বা একটি পাথরের গর্তে পানি জমানো রয়েছে। আশেপাশে কোনো ঝরনা বা ছড়া নেই, কোনো দিক থেকে পানি আসার কোনো চিহ্নও নেই। পানির উৎস জানতে চাইলে ল্যাং বললেন, পাহাড়ের ভেতর থেকে পানি আসছে। বিষয়টি মাথায় না ঢুকলেও শীতল পানির পরশে আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। তারপর আবারও সামিট করতে হলো ম্যানিয়াংপাড়ায়।
ছড়া থেকে ফিরে বসলাম রাতের খাবার রান্নার জন্য। হেড কুক রন্ধনরাজ হাসান ভাই। আমাদের সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার ও উপকরণ রয়েছে। তৈরি খিচুড়ি মিক্স, আলু, স্যুপ, নুডলস, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল সবই আছে। আমরা চাল ও তরকারি বহন করিনি পাড়া থেকে সংগ্রহ করব বলে। আর জুমের চালের রান্না করা ভাতের স্বাদই আলাদা। সারা দিন পেটে ভাত পড়েনি। ম্যানিয়াং দা’র ঘর থেকে দেড় কেজি চাল কিনলাম। চালকুমড়ো বা মিষ্টিকুমড়ো পাওয়া যায় কি না খোঁজ করলাম। পেলাম না। আমাদের সঙ্গে থাকা আলু দিয়ে ভর্তা করা হবে। আর ডাল রান্না করা হবে স্যুপ দিয়ে। হেড কুক হাসান ভাইকে রান্নার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সাহায্য করছেন কবি উসাই মারমা। উসাই কাটাকুটিতে সিদ্ধহস্ত। আর সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন কিরন ভাই।

ল্যাং মুরং আলু সিদ্ধ করলেন। এদিকে উসাই যখন আলুভর্তা শুরু করেন, তখন দেখা গেল আলু পুরোপুরি সিদ্ধ হয়নি। কিন্তু আমাদের পেটে তো সুচো দৌড়াচ্ছে! অপেক্ষা না করে অর্ধসিদ্ধ ভর্তা দিয়ে শুরু হয়ে গেল আমাদের রাতের খানা। ভর্তায় লবণ বেশি হয়েছে, না কি কম হয়েছে, সিদ্ধ হয়েছে কি না, স্যুপের ডাল আদৌ খাবারযোগ্য হয়েছে কি নাÑএসব নিয়ে প্রশ্ন করার কিংবা ভাবার সময় কারও ছিল না। জুম চালের ভাত, অর্ধসিদ্ধ আলুভর্তা আর টক স্বাদের স্যুপের ডাল দিয়ে আমরা পরম তৃপ্তিতে রাতের খাবার সারি। (চলবে)
শাহ জামাল চৌধুরী রেয়ার