Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:47 pm

ম্যানিয়াংপাড়ার পথে

ম্যানিয়াংপাড়া, আলীকদম, বান্দরবান

ম্যানিয়াংপাড়ায় আমরা রাতযাপন করতে যাচ্ছি। রাতের খাবার শেষ করতে করতে ১১টা পার হয়ে গেছে, এরপর ঘুমের পালা। ভোররাতে রংরাং ও খ্যামচংপাড়ার পথে যেতে হবে। তাই আজকের মতো আর ক্যাম্পিংয়ের ঝামেলায় না গিয়ে ম্যানিয়াং দা’র কাছ থেকে কয়েকটি কম্বল নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকা বালিশ, সিøপিং ব্যাগ ও চাদর বের করে ম্যনিয়াং দা’র ঘরের একপাশে শোয়ার আয়োজন করি। একটাই ঘর। একপাশে রান্নার ব্যবস্থা। একপাশে পরিবারের লোকজনের থাকার ব্যবস্থা। আর একপাশে আমরা। শুতে না শুতে ঘুম। কিন্তু পাড়াটা চাঁদের আলোয় ঘুরে না দেখা পর্যন্ত আমার ঘুম আসছিল না।

ভরা পূর্ণিমা রাতে ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর লোভ সামলানো সহজ নয়। পারলামও না। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটু পর দেখি ম্যানিয়াং মুরংও এসেছেন। চাঁদের আলোয় গ্রামটা ঘুরে দেখছিলাম। ম্যানিয়াংয়ের কাছে শুনছিলাম তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উৎসবের কথা।

ম্যানিয়াংপাড়া একটি মুরংপাড়া। পাঁচ পরিবারের সবাই মুরং। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী তারা। বান্দরবানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্রনৃষ্ঠীর অধিবাসী তারা। মুরংদের আদি নিবাস মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে। আনুমানিক ১৪৩০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৯০ বছর আগে ম্রোরা বান্দরবানের লামা, আলীকদম, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মুরংরা মূলত প্রকৃতিপূজারি হলেও অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অনেকে খ্রিষ্টধর্ম পালন করেন। তবে কিছুদিন আগে মুরংদের মধ্যে একটা নতুন ধর্ম ‘ক্রামা’র আবির্ভাব হয়েছে। ফলে বর্তমানে মুরংদের একটি অংশ ক্রামা ধর্মের অনুসারি বনে গেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে মুরংরা আরকান থেকে পালিয়ে আলীকদমের বিভিন্ন পাহাড়ি উপত্যকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এ সম্প্রদায়ের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তাদের একটি অংশ আলীকদমের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে ‘কিম’ ঘর তৈরি করে বসতি স্থাপন করে। মুরংরা ঘরে জীবজন্তুর মাথা ঝুলিয়ে রাখতে অভ্যস্ত।

প্রকৃতিকেই তারা ইহকালের সর্বস্ব জ্ঞান করেন। তাদের মতে পরকাল বলতে কিছু নেই। মুরংদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ-সংবলিত কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। তাদের ধর্মবিশ্বাসে আকীর্ণ প্রধান উৎসব হচ্ছে ‘চিয়া-ছট-প্লাই’ অর্থাৎ গো-হত্যা উৎসব। গো-হত্যাকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে পালন করা হয়। প্রতিবছর জুমের ফসল ঘরে তোলার আগে মহা ধুমধামে তারা এ উৎসব উদ্যাপন করে। এছাড়া রোগবালাই থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘চিয়া-ছট-প্লাই’ পালনের মানত করে থাকে। তারা ‘চাম্পুয়া’ নামের আরেকটি একটি উৎসব পালন করে। সৃষ্টিকর্তা তাদের ধর্মীয় বিধান কলাপাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ বিশ্বাসের বলে তারা কলাপাতা কেটে এ উৎসব পালন করে।

তারা মৃতদেহ সপ্তাহখানেক ঘরের মধ্যে রাখে। মৃত ব্যক্তির পাশে শূকর, ছাগল ও মোরগ জবাই করে পরিবেশন করে। শবদেহকে নদীতীরবর্তী চিতায় দাহ করার আগ পর্যন্ত গানবাজনা ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে উল্লাস করার প্রচলন রয়েছে।

এক-দেড় ঘণ্টা চারপাশে ঘুরেও সাধ মেটেনি। এ এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। দুঃখ একটাইএ সৌন্দর্য ক্যামেরায় বন্দি করা আমার সাধ্য নয়। সাড়ে ১২টা কি ১টার দিকে ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। মধ্যরাত যখন পেরিয়ে গেছে, ভোরের আলো ফোটেনি, তখন উঠে পড়লাম। আমাদের তো আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। কারণ খুব ভোরে খ্যামচংপাড়ায় পৌঁছাতে হবে। আমরা দিনের রোদে ট্রেকিং করার চেয়ে রাতের বেলায় ট্রেকিং করাটাই পছন্দ করছি। রোদের মধ্যে পাহাড়ে ট্রেকিং করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য। তাই দ্রুত রেডি হয়ে নেমে পড়ি রংরাংয়ের পথে। (চলবে)

  শাহ জামাল চৌধুরী রেয়ার