Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:39 pm

ম্যারিকোর বিরুদ্ধে আয় গোপন ও কর ফাঁকির অভিযোগ

রহমত রহমান: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড। বহুজাতিক এই কোম্পানির বিরুদ্ধে এক অর্থবছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকা আয় গোপনের অভিযোগ উঠেছে, যার বিপরীতে কর পরিশোধ করা হয়নি প্রায় ২৮ কোটি টাকা। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি খাতে অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে, যাতে এই অনিয়ম উঠে এসেছে। পরিহার করা এই রাজস্ব আদায়ে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দিয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন দেয়া হয়। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের আওতাধীন তিনটি কর অঞ্চলের অধীনে ১০টি কর সার্কেলের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ২০১৯-২০ করবর্ষের (২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত) ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট (এআইআর) সম্পন্ন করেছে, যার মধ্যে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের আয়কর গোপনের মাধ্যমে অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড কর অঞ্চল-৩, ঢাকার অধীন ৪৫ সার্কেলের (কোম্পানিজ) করদাতা প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৯-২০ করবর্ষে ৮২ (বিবি) ধারায় আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। ওই রিটার্নে পাঁচটি খাতে ম্যারিকো ওই আয় গোপন করেছে, যার মধ্যে দেখা যায়, করদাতা প্রতিষ্ঠান ম্যারিকোর বার্ষিক প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল রিপোর্ট) ‘প্রফেশনাল অ্যান্ড লিগ্যাল চার্জ’ হিসেবে দুই কোটি ২৮ লাখ তিন হাজার সাত টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৫২ ধারা অনুযায়ী এর ওপর ১২ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই খরচের ওপর উৎসে কর কর্তন করেনি। এমনকি এই কর পরিশোধের কোনো চালান বা প্রমাণক নিরীক্ষার সময় পাওয়া যায়নি। ফলে এই আয় অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে।

প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ওই অর্থবছর ‘বিজ্ঞাপন’ খাতে ৫৫ কোটি ৮৭ লাখ ২১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা খরচ দাবি করেছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী এর ওপর চার শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি এবং নিরীক্ষার সময় এ-সংক্রান্ত কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। ফলে এই আয় অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে।

বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ওয়ার্কার প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড’ হিসেবে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৭ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল থেকে সুবিধাভোগীদের অর্থ পরিশোধের সময় পরিশোধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেবেন। কিন্তু এর ওপর উৎসে কর কর্তন করা হয়নি। নিরীক্ষার সময় এ-সংক্রান্ত কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। ফলে এই আয় অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে।

অপরদিকে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ওই অর্থবছর ‘ফ্রেইট আউটওয়ার্ড’ বাবদ ছয় কোটি ৯৭ লাখ ১৭ হাজার ৪৭৮ টাকা খরচ দাবি করেছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই খরচের উপর পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ওই উৎসে কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এছাড়া নিরীক্ষায় কোন প্রমাণক পাওয়া যায়নি। ফলে আইন অনুযায়ী, এই আয় অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে।

অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৯-২০ অর্থবছর আয় দেখিয়েছে ২৭৭ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৯৯৩ টাকা। তবে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর তথ্য যাচাই করে প্রতিষ্ঠানটির ওই অর্থবছর পাঁচটি খাতে বাড়তি ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯৭ টাকা আয় খুঁজে পেয়েছে, যার ওপর ৩৫ শতাংশ হারে কর দাঁড়ায় ২৭ কোটি ৮৫ লাখ ৮৭ হাজার ৮৮৯ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ না ফাঁকি দিয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে পরিহার করা এই আয়কর আদায় ও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ গোপালের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হয়। তবে রিসিভ করার পর আয় গোপনের বিষয়টি শোনার পরপরই তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। এরপর কয়েক দিন একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া খুদেবার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি।

এ বিষয়ে ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ইলিয়াস আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের পর ট্যাক্স অফিস থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, কিছু কাগজপত্র নেই। আমরা রেসপন্স করেছি। প্রসেসিং রয়েছে। এটা তো নরমাল প্রসেস।

উল্লেখ্য, মুম্বাইভিত্তিক এফএমসিজি কোম্পানি ম্যারিকো ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। গাজীপুরের মৌচাক ও সিরিরচালায় অবস্থিত ম্যারিকোর কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে নেপালে রপ্তানি হচ্ছে। ম্যারিকোর আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যবসার ৪৯ শতাংশই আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বাজারে ম্যারিকোর রাজস্ব আয়ের ৬৫ শতাংশই আসে প্যারাশুট ব্র্যান্ডের নারকেল তেল থেকে। ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৯০ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে পাঁচ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দুই দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে দুই শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক বছরে শেয়ারহোল্ডারদের ৯৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে। সর্বশেষ গতকাল এ কোম্পানিটির শেয়ার দুই হাজার ১২৪ টাকা ৭০ পয়সায় কেনাবেচা হতে দেখা গেছে।