বিশেষ প্রতিনিধি : শুরু থেকে বিতর্ক পিছু ছাড়ছিল না রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের। সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় এ প্রকল্পটি নিয়ে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ছাড়াও দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হয়েছে। তবে সবকিছু উপেক্ষা করেই বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। গত ডিসেম্বরে এর প্রথম ইউনিটটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করলেও নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
কয়লা সংকটে এরই মধ্যে দুই দফা বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বাকিটা সময় চললেও পূর্ণ সক্ষমতার ব্যবহার খুবই কম হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কারিগরি ত্রুটি। এ কারণে ছয় মাসে দুবার বন্ধ হলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৫ এপ্রিলের পর ৩০ জুন কেন্দ্রটি দ্বিতীয় দফা বন্ধ হয়েছে কারিগরি ত্রুটির কারণে। রক্ষণাবেক্ষণশেষে ৫-৬ জুলাই আবার উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে এ কেন্দ্রের।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতা কোম্পানি বিআইএফপিসিএলের (বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরামুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ৩০ জুন রাতে প্রথম ইউনিটের ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর ইউনিট প্রোটেকশনে সমস্যা দেখা দেয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন ত্রুটি সারানোর কাজ করা হচ্ছে। আগামী ৫ বা ৬ জুলাইয়ের দিকে প্রথম ইউনিট থেকে আবারও উৎপাদন শুরু করা হবে।
যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কারিগরি ত্রুটির জন্য মানহীন যন্ত্রপাতি ব্যবহারকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা। তারা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি একক ভেন্ডর থেকে সংগ্রহ করা হয়নি, বরং পৃথক পৃথক টেন্ডারে ভিন্ন ভিন্ন সররবরাহকারীর কাছ থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে উৎপাদন শুরুর আগে থেকেই নানা ধরনের ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। তবে এসব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় পিডিরিব কর্মকর্তাদের রাখা হয়নি। বরং ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশনের (এনটিপিসি) প্রকৌশলীরা এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
প্রসঙ্গত, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বিআইএফপিসিএল। এতে বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির ৫০ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ঠিকাদার কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। এটি নির্মাণে কঠিন শর্তে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। আর এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা করে ইক্যুইটি বিনিয়োগ করেছে পিডিবি ও এনটিপিসি।
সূত্রমতে, পটুয়াখালীতে নির্মিত পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেকটা একই মডেলে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ ও চীনের সমান যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২০ সালে উৎপাদন শুরু করে। তবে কয়লা সংকটে গত মাসে এটি বন্ধের আগে কারিগরি ত্রুটির কারণে কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।
নি¤œমানের প্রযুক্তির কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্বন নিঃসরণ হবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি। এছাড়া আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির চেয়ে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় অনেক কম। তবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পায়রার চেয়ে অনেক বেশি। গত ডিসেম্বরে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণী তৈরি করে পিডিবি, যাতে এ তথ্য উঠে আসে।
ওই বিশ্লেষণে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। পূর্ণ সক্ষমতায় এ কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৭ কোটি ১৯ লাখ দুই হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে মাসে তিন কোটি ২৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে চার দশমিক ২১ সেন্ট বা চার টাকা ৫০ পয়সা (এক ডলার=১০৬.৯৫ টাকা ধরে)।
অন্যদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯৭ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে মাসে তিন কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়বে চার দশমিক ৮৫ সেন্ট বা পাঁচ টাকা ১৯ পয়সা। অর্থাৎ নি¤œমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও রামপালের ক্যাপাসিটি চার্জ ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি।
সূত্র জানায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথম বছরের পরিচালন ব্যয় নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে সমঝোতা স্মারক সইয়ের সময় ২০১০ সালে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না। তাই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম বছরের পরিচালন ব্যয়ের ভিত্তি ধরা হয়েছিল ফারাক্কায় অবস্থিত এনটিপিসির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে রামপালে পরবর্তী বছর থেকে ২৫তম বছর পর্যন্ত প্রকৃত পরিচালন ব্যয় পরিশোধ করা হবে।
যদিও ফারাক্কায় অবস্থিত এনটিপিসির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা নিয়ে আপত্তি তুলেছে পিডিবি। সংস্থাটি সম্প্রতি এনটিপিসিকে দেয়া এক চিঠিতে জানায়, ফারাক্কায় অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১২ বছরের পুরোনো। তাই এর পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। ওই কেন্দ্রকে এখন আর ভিত্তি ধরার উচিত হবে না। এক্ষেত্রে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম বছরের পরিচালন ব্যয়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা, অথবা প্রকৃত খরচকে বিবেচনার শর্ত দেয়া হয়।
এর বাইরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োজিত পিডিবি ও এনটিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সূত্র জানায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ভারতের প্রকৌশলীদের বেতন-ভাতা বেশি ধরা হয়েছে। এ কেন্দ্রে ৫৫ ভারতীয় নাগরিক কর্মরত রয়েছেন, যারা এনটিপিসির স্কেলে বেতন-ভাতা পান। আর পিডিবির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত স্কেলে বেতন পান। আর এনটিপিসির বেতন-স্কেল পিডিবির দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া ভারতের প্রকৌশলীদের দৈনিক ভাতা (ডিএ) হিসেবে মাসে সাড়ে তিন হাজার ডলার দেয়া হয়, যা পিডিবির কর্মকর্তারা পান না। এতে ভারতের কর্মকর্তারা পিডিবির কর্মকর্তাদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেতন-ভাতা পান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ‘আমরা শুনেছি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোয়ালিটি ফেইল করেছে। সেখানে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যারা এই কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন, তারাই বলেছেন সবকিছু বিবেচনায় রামপাল আর পায়রার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রামপাল যারা নির্মাণ করছে, তারা কেন গুণগত মান ঠিক করল না, সেটা দেখার বিষয়। না হলে পুরো বিষয় ভেস্তে যাবে, যা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। কারণ নির্ধারিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারলে জরিমানা করা হয়। রামপালের ক্ষেত্রে এটা হলে সেই জরিমানা তো বাংলাদেশকেও দিতে হবে।’
জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, নতুন যেকোনো কিছুর শুরুতেই অনেক ঝামেলা হয়। রামপালের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। নি¤œমানের যন্ত্রপাতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। আশা করছি সমস্যার সমাধান হবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ভালো না হলেও অন্তত ওই কেন্দ্রের মতো গুণগত মান যেন রামপালে ঠিক থাকে, সে ব্যাপারে আমরা বলেছি।’