Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 6:16 pm

যন্ত্রাংশ ঘোষণায় মোটরসাইকেল আমদানি করে টিভিএস অটো

রহমত রহমান: মোটরসাইকেল আমদানি করা হয়েছে সিকেডি (বিযুক্ত অবস্থায়)। কিন্তু ঘোষণা দেয়া হচ্ছে পার্টস আকারে (একটি একটি করে খোলা বা যন্ত্রাংশ)। পার্টস অব কম্পোনেন্টের এইচএস কোডে শুল্কায়ন করে খালাস নেয়া হয়েছে সিকেডি মোটরসাইকেল। মূলত শুল্ককর ফাঁকি দিতে দীর্ঘদিন ধরে এমন মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাস নিচ্ছে মোটরসাইকেল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ। সর্বশেষ বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে ১৩টি চালান খালাস নেয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির শুল্ককর ফাঁকির চিত্র উঠে এসেছে। শুল্ককর ফাঁকি দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেনাপোল কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ প্রতিবেদন দেয়া হয়।

অন্যদিকে, এর আগে টিভিএস অটো বাংলাদেশ একইভাবে ২৮টি চালান শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস নিয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৮ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি উদ্ঘাটন করে এনবিআরকে প্রতিবেদন দিয়েছে।

যদিও শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি অস্বীকার করেন টিভিএস অটো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিপ্লব কুমার রায়। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একটি এইচএস কোডের ডেফিনেশন নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। আমরা এ নিয়ে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করেছি।’

শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ ১৩টি চালানে বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে পণ্য খালাস নিয়েছে। এর মধ্যে ১৬ নভেম্বর ভারত থেকে আমদানি করা মোটরসাইকেল সিকেডি অবস্থায় খালাস নেয়া হয়েছে। যদি প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে অসত্য এইচএস কোডে শুল্কায়ন করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি করা পণ্য চালানের মাধ্যমে সিকেডি মোটরসাইকেলকে ‘পার্টস অব কম্পোনেন্ট’ বা যন্ত্রাংশ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যন্ত্রাংশ ঘোষণায় এইচএস কোড ৮৭.১৪.১০.৯০ শুল্কায়ন করা হয়েছে। যার মোট শুল্ককর ৫৩ শতাংশ (কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ ও এটি ৫ শতাংশ)। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যায়িত আমদানি-সংশ্লিষ্ট দলিলাদি (ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট) যাচাই করে দেখা যায়, আমদানি করা মোটরসাইকেল সিকেডি আকারে আমদানি করা হয়েছে।

শুল্ক মূল্যায়ন যাচাই করে দেখতে পায়, আমদানিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে প্যাকিং লিস্ট অনুযায়ী বিভিন্ন বক্সে মোটরসাইকেলের একেকটি পার্টসের ১২০, ২৪০ সংখ্যক বিভিন্ন পার্টস সংরক্ষিত আছে। সিকেডি অবস্থায় প্রেরিত ডিটেইলড প্যাকিং মোতাবেক উৎপাদনযোগ্য মোটরসাইকেলের ব্র্যান্ড, মডেল ও কালার ইত্যাদি নিরূপণ করা আছে। ফলে এ জাতীয় এক বা একাধিক ঘোষিত পার্টস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ মোটরসাইকেল তৈরির সব কম্পোনেন্ট এতে বিদ্যমান রয়েছে।

এনবিআরের ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি জারি করা আদেশ অনুযায়ী, আমদানিকৃত পণ্য চালানগুলো সিকেডি আকারে হওয়ায় এইচএস কোড ৮৭১১.২০.২১-এর বিপরীতে শ্রেণি বিন্যাসযোগ্য। যার মোট শুল্ককর ৭৩ শতাংশ (কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ ও এটি ৫ শতাংশ)। তবে প্রতিষ্ঠানটি অসত্য এইচএস কোড ৮৭.১৪.১০.৯০ শুল্কায়ন করে ১৪টি চালান খালাস নিয়েছে। যাতে দুই কোটি ৬৭ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৬ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে।

এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এসআরও সুবিধায় এ প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে। তবে ফাঁকির সুযোগ নেই। মাঝে মধ্যে এক পার্টসের জায়গায় অন্য পার্টস নিয়ে এলে আমরা আটক করি। তবে শুল্ক মূল্যায়ন যে ১৩টি চালানে শুল্ককর ফাঁকি পেয়েছে, সেই চিঠি এখনও বেনাপোল কাস্টম হাউসে আসেনি বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড ভারত ও বাংলাদেশের একটি জয়েন ভেঞ্চার কোম্পানি। ভারতের টিভিএস অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড ও বাংলাদেশের রেইন মোটরস বাংলাদেশ যৌথভাবে এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে দেশের মোটরসাইকেলের ১৫ শতাংশ বাজার এ কোম্পানির দখলে রয়েছে।

অন্যদিকে, এর আগে কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে যন্ত্রাংশ আমদানির ঘোষণা দিয়ে সিকেডি মোটরসাইকেলে আমদানি করে সাড়ে ৮ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ওই চালানের পণ্য গোপনে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খালাস নেয়। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে বিষয়টি ধরা পড়েছে। এ নিয়ে এনবিআরের নির্দেশে বেনাপোল কাস্টম হাউস কমিটি গঠন করে।

কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স শামছুর রহমান ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাগজপত্র জাল করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে পণ্য চালানগুলো খালাস নেয়া হয়েছে। মোটরসাইকেলের সঠিক এইচএস কোড-৮৭১১.১০২১ (টিটিআই) যার ডিউটি-৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশের পরিবর্তে এইচএস কোড ৮৭১৪.১০৯০ (টিটিআই), যার ডিউটি ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। শুল্কায়নপূর্বক ২৮টি পণ্য চালানে ৮ কোটি ৩০ লাখ ৩ হাজার ৪৪ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়।