যমুনায় বাড়ছে পানি, নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ :ভারতে টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী ও চলনবিলে পানি আসতে শুরু করছে। ফলে নদী ও বিলাঞ্চলে আগাম বর্ষাকে মোকাবিলা ও প্রস্তুতি নিতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট-বড় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।

এদিকে, নৌকা তৈরির কারিগরদের পাশাপাশি যমুনার চরাঞ্চলের মাঝিরাও পুরোনো নৌকাগুলো মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের একটুও দম ফেলার ফুসরত নেই। তবে সারাবছর নৌকা তৈরির কোনো কাজ না থাকলেও বর্ষা মৌসুমের জন্য অপেক্ষায় থাকেন কারিগররা।

রোববার (১৮ জুন) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে যমুনা নদী-তীরবর্তী ৫টি উপজেলার মধ্যে সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও তাড়াশ উপজেলার চলনবিল এলাকার বিভিন্ন হাটবাজারে কারিগররা তাদের নিপুণ ছোঁয়ায় ছোট-বড় নৌকা তৈরি করছেন। নৌকা তৈরির হওয়ার পরে কেউ রং করছে আবার কেউ আলকাতরা ও গাবের পানি ব্যবহার করছে। কেউ করাত দিয়ে কাঠ কাটছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে নৌকায় পেরেক লাগাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল নিচু হওয়ায় সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও তাড়াশের চলনবিলের অধিকাংশ এলাকা বর্ষা মৌসুমে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়। নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাটে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় নৌকা। এসব স্থানে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার জন্য নৌকাই তাদের ভরসা। চলাচলের পাশাপাশি মাছ শিকারের জন্য ছোট-বড় নৌকা ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে বর্ষা মৌসুম আসার আগেই নৌকা তৈরি ও মেরামতের হিড়িক পড়েছে।

তাড়াশের নওগাঁ হাটের নৌকা বিক্রেতা আব্দুস ছালাম বলেন, উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারের কারখানায় তৈরি করা নৌকা কিনে এনে হাটে হাটে বিক্রি করি। বন্যার সময় এই উপজেলাসহ চলনবিলাঞ্চলে নৌকার চাহিদা প্রচুর।

কাজিপুরের সোনামুখী গ্রামের অমল চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ১০ হাত লম্বা এবং আড়াই হাত প্রস্থের একটি নৌকার মূল্য পাঁচ হাজার টাকা। আকার ভেদে নৌকার দামের তারতম্য হয়। এ রকম ১১ হাত লম্বা ও ৩ হাত প্রস্থের নৌকা ৬ হাজার, ১৩ হাত লম্বা ও ৩ হাত প্রস্থের একটি নৌকার দাম ৭ হাজার আর ১৫ হাত লম্বা ও ৩ হাত প্রস্থের নৌকা আট থেকে নয় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নৌকা ক্রেতা নাদোসৈয়দপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, বন্যায় নিচু সড়ক ডুবে যায়। তাই পরিবারের সদস্যদের পারাপার করার জন্য ছোট নৌকা ৫ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন।

সদর উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী শুভগাছা গ্রামের জেলে শাহ আলী জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীতে মাছ শিকারের জন্য ১২ হাত লম্বা একটি নতুন নৌকা তৈরি করা হয়েছে। এ নৌকা তৈরিতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা।

সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের দোরতা চরের হাফিজ উদ্দিন জানান, প্রতি বছরই যমুনা নদীতে পানি আসার আগেই নতুন নৌকা তৈরি ও পুরোনো নৌকা মেরামত করা হয়। নতুন একটি ৪০ হাতের নৌকা তৈরি করতে দেড় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। সময় লাগে প্রায় দুই মাস। তাই আগে থেকে নৌকা তৈরি না করলে বর্ষা এলে বিপাকে পড়তে হয়। যে কারণে নদী পাড়ের মানুষ বর্ষার আগেই নৌকা তৈরি করে থাকেন।

নৌকা তৈরির কারিগর বিমল কুমার জানান, একটা বড় নৌকা তৈরি করতে আমাদের দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগে। আমরা দৈনিক ৮০০ টাকা হাজিরায় কাজ করি। প্রতি বছর তিন-চারটি বড় নৌকা তৈরি করি। এছাড়া ছোট ও ডিঙি নৌকা তৈরি ও বিক্রি করি।

শহরের ফার্নিচার ব্যবসায়ী কবির হোসেন জানান, এমনিতে খুচরা ও বিভিন্ন হাটে বিক্রির উদ্দেশে কমদামি খাট, চৌকি, ঘরের দরজা, জানালা তৈরি করি। বর্ষা মৌসুমে নৌকা তৈরি করা হয়। এ সময় কারিগররা দম ফেলার সময় পায় না। একজন কারিগর দিনে একটা নৌকা তৈরি করতে পারে। সারা সপ্তাহ যা নৌকা তৈরি করা হয় খুচরা দুই একটা বিক্রি ছাড়া সব নৌকা বিক্রি হয় শাহজাদপুর ও তাড়াশের বিভিন্ন হাটবাজারে। বর্তমানে তেমন বিক্রি নেই। তবে নদীতে পানি বাড়লে বিক্রিও বাড়ে। এবার ৮ থেকে ১০ হাত নৌকা ৪-৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নৌকা বড় হলে দামও বৃদ্ধি পায়।

কাজীপুর উপজেলার নাটুয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মানান্ন জানান, প্রতি বছরই যমুনা নদীর তীরবর্তী উপজেলায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। এ সময় বাড়ি ঘরের পানি ওঠায় এলাকাবাসী ভোগান্তিতে পড়ে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে নৌকা দেয়া হয় চাহিদা তুলনায় খু?বই কম। এসব নৌকা দিয়ে স্থানীয় এলাকায় কোনো রকম চলাচল করা যায়। কিন্তু দূর-দূরান্তে যেতে হলে ব্যক্তিগত নৌকায় ভাড়া দিয়ে চলাচলা করতে হয় স্থানীয়দের।

সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়া মুন্সী জানান, বর্ষা মৌসুমে পুরো কাওয়াকোলা ইউনিয়নটি চরাঞ্চলে হওয়ায় তাদের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে নিচু অঞ্চলের মানুষের বর্ষায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। তাই নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই নৌকা কিনে রাখছেন। বর্ষা মৌসুমে নৌকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০