মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: রেণু-পোনা উৎপাদনের শেষ সময়ে বৃষ্টি হওয়ায় বাজার যখন জমজমাট, ঠিক তখনই সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে যশোরের রেণু-পোনার বাজারে। লোডশেডিংয়ের কারণে সেচচালিত পাম্প দিয়ে মাছের পোনা ও রেণু উৎপাদন, যানবাহনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ, সবক্ষেত্রেই খরচ হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। সংকটে পড়েছেন মাছচাষি ও ব্যবসায়ীরা। কঠিন হয়ে পড়েছে রেণু-পোনার উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনা। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন যশোরের হ্যাচারি মালিক ও মাছ ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, যশোর শহরতলির চাঁচড়া বাবলাতলা মৎস্য পোনা বাজার থেকে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক, পিকআপে করে রেণু-পোনা চলে যায় দেশের ২১ জেলায়। চৈত্র থেকে মধ্য আষাঢ় পর্যন্ত রেণ-পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম হলেও এবার দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে পোনা বেচাকেনার বাজার তেমন জমে ওঠেনি। এক সপ্তাহ ধরে বিরতি দিয়ে মাঝেমধ্যে শ্রাবণের বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা বেচাকেনা শুরু হলেও ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোলসহ সব জ্বালানির দাম বাড়ায় চরম সংকট তৈরি হয়েছে।
গতকাল যশোরের চাঁচড়ার বাবলাতলা পোনা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মাছের রেণু ও পোনা বিক্রেতারা হাঁড়ি নিয়ে সারি সারি বসে থাকলেও সেখানে নেই কোনো ক্রেতা। কয়েকজন পাইকার ব্যবসায়ীর দেখা মিললেও তারা মাছের পোনা কিনছেন না।
কথা হয় খুরশিদ আলম নামে একজন রেণু ও পোনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ৩০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে এমন সংকট কখনও দেখিনি। এমনিতে করোনার কারণে গত দুই বছরে আমরা চরম লোকসানে ছিলাম। এরপর ভরা মৌসুমে প্রত্যাশিত বৃষ্টি না পাওয়া মাছের পোনা ও রেণু বিক্রি শিকেয় ওঠে। শেষ সময়ে সামান্য বৃষ্টি পেয়ে যখন আমার বেচাকেনা শুরু করেছি তখন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং আমাদের পথে বসানোর পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
মাছচাষি আলমগীর হোসেন বলেন, মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদনের সঙ্গে পর্যাপ্ত পানির বড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে এ বছর সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমাদের সেচনির্ভর হয়ে পড়তে হয়। এর মাঝে সরকারের সিদ্ধান্তে লোডশেডিং চলে। এ অবস্থায় আমাদের ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে হাপায় পানি দিয়ে মাছের পোনাকে নিরাপদে রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। যে কারণে আমরা বাধ্য হয়ে মাছের পোনা ও রেণুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছি।
বাগেরহাট জেলার ঝালকাটি থেকে আসা পাইকার শাহাজান আলীর সঙ্গে দেখা হয় পোনা বাজারে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মাছচাষিদের পথে বসানোর জন্যই সরকার তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সব কিছুর ওপর প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, আগে যশোর থেকে ছোট পিকআপে করে চট্টগ্রামে মাছের পোনা পাঠাতে খরচ হতো ৩২ হাজার টাকা। অথচ এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। কুমিল্লার ভাড়া ছিল ২১ হাজার বর্তমান চার হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার। ফেনী বাড়িহাটে পাঠাতে পরিবহন খরচ হতো ২৬ হাজার এখন তা বেড়ে ৩২ হাজার হয়েছে। এভাবে প্রত্যেক রুটেই গাড়ি প্রতি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে।
যশোর জেলা মৎস্যচাষি ও হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে যশোরের মাছচাষিরা বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। অথচ সারাবছরই তাদের বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দিয়ে আসতে হচ্ছে। মাছ চাষ কৃষির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকার পরও আমরা অকারণে শিল্পরেটে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে আসছি। এর পরও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে আমরা বিপর্যস্ত। সর্বশেষ ডিজেল কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত যারা তারা পথে বসতে চলেছে। তিনি বলেন, সংকট থেকে উত্তরণে এই মুহূর্তে সরকারি প্রণোদনার কোনো বিকল্প নেই। সরকার যদি মাছচাষিদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তাহলে আগামীতে যশোর জেলায় মাছচাষিদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাবে