Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:36 pm

যশোরে আমন সংগ্রহ নিয়ে সংশয়

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় যশোরে খাদ্য বিভাগের চলতি আমন সংগ্রহ অভিযানের সফলতা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। গত ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া জেলার আমন সংগ্রহ অভিযান দীর্ঘ ২৫ দিনে পার হলেও এখনও এক কেজি ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্যবিভাগ। তবে, গত রোববার পর্যন্ত জেলায় মোটা চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮০ মেট্রিক টন।

কৃষক ও মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধান ও চালের দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। বর্তমান বাজার অনুযায়ী ধান ও চাল সরবরাহ করতে গেলে গুনতে হবে লোকসান; সে কারণে হওয়ায় সরকারি গুদামে ধান ও চাল বিক্রিতে আগ্রহ হারিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে যশোর জেলায় আমন সংগ্রহ সফল না হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে। তবে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ধানের বাজার স্বাভাবিক হলেই কৃষক ও মিল মালিকরা স্বচ্ছন্দে ধান ও চাল সরবরাহ করতে পারবে।

যশোর জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোর জেলার আমন সংগ্রহ অভিযানে ১৪ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে ৪ হাজার ৯৯৮ মেট্রিক টন ধান এবং মিল মালিকদের কাছ থেকে ৪২ টাকা কেজিদরে ৯ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৭ নভেম্বর আমন সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে খাদ্য বিভাগ। আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংগ্রহ অভিযান চলবে।

জেলা খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, গত রোববার বিকাল পর্যন্ত জেলার ৮ উপজেলার কোনো খাদ্যগুদামে এক কেজি ধানও সংগ্রহ হয়নি। শুধু শার্শা উপজেলায় ৮০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। ধান ও চালের বর্তমান বাজার দরের বিস্তর পার্থক্য থাকায় এ পরিস্থিতি বলে খাদ্য বিভাগের লোকজন দাবি করছেন।

যশোর জেলা খাদ্য অফিসের প্রধান সহকারী (প্রশাসন ও সংগ্রহ) উজ্জল কুমার দাস বলেন, ইতোমধ্যে যশোর জেলার ৮ উপজেলায় মোট ৫৯ জন মিলার খাদ্য অফিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে শার্শা উপজেলায় ২১ জন, সদরের ৬ জন, অভয়নগরের ১ জন, কেশবপুরে ৭ জন, ঝিকরগাছায় ৬ জন, চৌগাছায় ১১ জন ও মণিরামপুরে ৭ জন মিলার রয়েছেন। তবে বাঘারপাড়া উপজেলায় এখন পর্যন্ত কোনো মিলার চুক্তিবদ্ধ হননি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত জেলার শার্শা থেকে ৮০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। আশা করা যায়, সামনে আরও মিলাররা চুক্তিবদ্ধ হবেন।

এদিকে খাদ্য অফিসের সঙ্গে মিলাররা চুক্তিবদ্ধ হলেও তারা বেশি দামে ধান ও চাল কিনে খাদ্যগুদামে বিক্রি করতে একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে জানান তারা। মিলারদের অভিযোগ গত কয়েক বছর ধরে সরকারের বেঁধে দেয়া দরে ধান-চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা লোকসান গুনে আসছেন। এ বছর তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি। বর্তমান বাজার দর ও সরকার নির্ধারিত দামের বিস্তর ফারাক থাকায় তারা চাল দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। চুক্তিতে আসার মতো অনেক যোগ্য মিলার এখন পর্যন্ত সাড়া দিচ্ছেন না খাদ্য বিভাগের আহ্বানে। তবে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের আশা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তালিকাভুক্ত মিলাররা চুক্তিতে আসবেন।

এ বিষয়ে যশোর খাদ্য অফিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ মিলার এসকে অটো রাইস মিলের নজরুল ইসলাম বলেন, বাজারে ধান ও চালের দামের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত দামের কোনো সামঞ্জস্য না থাকায় এ বছর আমরা চাল দিয়ে লাভ করতে পারব কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছি। তারপরও লাইসেন্স রক্ষার জন্য আমাদের চাল দিতে হবে। তবে আমাদের দাবি সরকার যেন বাজারের ধান-চালের দামের সঙ্গে আমাদের মিলারদের নির্ধারিত দামের সমন্বয় করে দাম পুনর্নির্ধারণ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মিলার বলেন, আমরা এখন উভয় সংকটে আছি। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ধান কিনে আগের দুই বছর আমাদের সরবরাহ করতে হয়েছে। এতে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবারও একই অবস্থা। তারপরও আমাদের লাইসেন্স রক্ষা করতে গিয়ে জেনেশুনেই আগুনে ঝাঁপ দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুললে আগামীতে আর খাদ্য বিভাগ থেকে কোনো চুক্তি করবে না বলে অনেক মিলার কথা বলছেন না বলে তিনি

দাবি করেন।

একই অবস্থা কৃষক পর্যায়েও। বাজারে ধানের দামের চেয়ে সরকার নির্ধারিত দাম কম হওয়ায় কৃষকরা ধান দিতে একেবারেই আগ্রহ হারিয়েছে। জেলার সদর উপজেলার মনোহরপুর এলাকার কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, যশোরাঞ্চলের কৃষকরা মূলত চিকোন ধানের চাষ করেন। এসব ধানের বর্তমান বাজার দর ১২ থেকে ১৩শ টাকা। এর আগে ধান ক্ষেত থেকে ঘরে তুলার সময় আরও বেশি দাম ছিল। যে কারণে কৃষকরা বাজারে ধান বিক্রি করে দিয়েছে। সে কারণে খাদ্য গুদামে ধান বিক্রিতে কোনো কৃষকের আগ্রহ নেই বলে তিনি দাবি করেন। 

জেলার বাঘারপাড়ার ধান ও চাল ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান ও নিজাম উদ্দীন বলেন, কেজিপ্রতি চাল উৎপাদনে তার খরচ হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা। এ অবস্থায় সরকারের নির্ধারিত ৪২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করলে তাদের পথে বসতে হবে। যে কারণে অধিকাংশ মিলাররা খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে না বলে এই দুই ব্যবসায়ী জানান। 

এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু বলেন, আমরা এখনও আশা হারাচ্ছি না। আশা করছি এর মধ্যে আমরা ধান ও চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হবো। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই মিলারদের সঙ্গে তাদের চুক্তিবদ্ধ চাল দেয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছি। মিলাররা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করবেন। আর ধান সংগ্রহের জন্য কৃষক পর্যায়ে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য জেলার সব উপজেলা এলাকায় প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।