Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:15 pm

যশোরে জ্বালানি কাঠের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি

মীর কামরুজ্জামান, যশোর: ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি)  অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে যশোরের মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নি¤œ মধ্যবিত্তদের সংসার জীবনে। এ কারণে সংসারের ব্যয় কমানোর জন্য অনেকেই ঝুঁকেছেন জ্বালানি কাঠের দিকে। এ সুযোগে জ্বালানি কাঠ বিক্রেতারাও মণপ্রতি ৭০ থেকে ১০০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫০ টাকাও বেড়েছে প্রতি মণে। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি কাঠের দাম বাড়ায় সংসার খরচের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

জানা গেছে, যশোরসহ আশপাশের কিছু জেলা থেকে জ্বালানি কাঠের বড় একটি অংশ কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণের কয়েকটি জেলার বিড়ি ও সিগারেট ফ্যাক্টরিতে সরবরাহের কারণে জ্বালানি কাঠের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, কাঠের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে পরিবেশের ওপর বড় প্রভাব ফেলার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

যশোর শহরতলির ঝুমঝুমপুর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামনে রমজান মাসে এলপি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও সংকটের শঙ্কায় অনেকেই আগেভাগে রান্নার কাজের জন্য জ্বালানি কাঠ কিনে বাসায় মজুত করে রাখছেন। আবার অনেক বড় বড় বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা যারা এতদিন গ্যাসের চুলায় রান্নার কাজ সারতেন তারা সংসারের খরচ সাশ্রয়ে গ্যাসের চুলার পাশাপাশি মাটির চুলা তৈরি করেছেন। এর বাইরে প্রতিদিনই ওই এলাকা থেকে ট্রাকে করে জ্বালানি কাঠ চলে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার বিড়ি কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে তামাক শুকানোর জন্য। এ বিপুল চাহিদার কারণে হঠাৎ জ্বালানি কাঠের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, ঠিক তেমনি সংকটও দেখা দিয়েছে।

রোববার বিকালে বিসিক এলাকার কাঠপট্টি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি খুচরা ও পাইকারী দোকানে সামনে কাঠ কেনার জন্য ক্রেতারা ভিড় করে আছেন। শহরের বকচর এলাকা থেকে এসেছেন মিতু ও সুমী নামে দুই বোন রান্নার জন্য কাঠ কিনতে। তারা বলেন, গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্যাসের চুলায় রান্নার কাজ সারতেন। কিন্তু এখন আর পেরে উঠছেন না। বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসেবে মাটির চুলা তৈরি করে কাঠ কিনতে এসেছেন। দুই মণ মেহগনির কাঠ ৫২০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে তারা জানান।

পাশেই কথা হয় আফজাল নামে আরেক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের মতো নি¤œ আয়ের মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। আগে এক মণ মেহগনির শুকনা কাঠ বিক্রি হতো ১৫০ টাকা মণ। এখন তা এক লাফে ২৫০ টাকা থেকে ২৭০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। ২৮০ টাকার মণ বাবলা কাঠ বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে কাঠ কিনে কীভাবে সংসার চালাবেন সেই চিন্তায় ঘুম আসছে না বলে তিনি জানান।

জ্বালানি কাঠ কিনতে আসা মিনতি রানী নামে এক এনজিও কর্মী বলেন, গ্যাসের চেয়ে জ্বালানি কাঠে রান্না অনেক সাশ্রয়ী। আমার সংসারে মাসে প্রায় ৪ মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। আগের হিসাবে আমার সংসারে জ্বালানি খরচ লাগত ১০০০ হাজার থেকে ১২০০ টাকা। এখন বাড়তি দাম হওয়ায় এর সঙ্গে আরও ৩০০ টাকা যোগ হয়ে খরচ হবে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা।

কথা হয় শরিফুল ইসলাম নামে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, রান্নার জন্য আমরা আগে কম দামে কাঠ কিনে নিয়ে যেতাম। এখন দেখছি বড় লোকেরাও রান্নার জন্য কাঠ কিনতে আসছে। এতে দাম বাড়ায় আমরা মুশকিলে আছি। সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। এ অবস্থায় কাঠের দামও যদি এভাবে বাড়তে থাকে আমরা বেঁচে থাকব কীভাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চেরাই করা প্রতিটি কাঠে মণ প্রতি ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। কথা হয় জ্বালানি কাঠ বিক্রেতা লিয়াকত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে গ্রাম জ্বালানি কাঠ খুব কম দামে কিনে আনতাম। এখন অনেক দাম বেড়ে গেছে। পরিবহন, কাঠ চেরাইয়ে কাঠুরেদের অতিরিক্ত শ্রমমূল্যের পাশাপাশি কাঠের সংকটও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বাড়তি দাম নেয়া ছাড়া তাদের পক্ষে কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি।

পাশেই কথা হয় পাইকারি ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, যশোর অঞ্চলের জ্বালানি কাঠের বড় মজুত যায় কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন বিড়ি ও সিগারেট কোম্পানির কারখানায়। তামাক শুকানোর জন্য এসব কাঠের ব্যবহার হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব। এসব কারণেই আমরা চাহিদামতো কাঠ সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছি। তিনি বলেন, সামনে রমজান মাসে গ্যাসের সংকটের পাশাপাশি দাম বৃদ্ধি পেতে পারে এমনটা আশঙ্কায় অনেক সামর্থ্যবান পরিবারও জ্বালানি কাঠ কিনে মজুত করে রাখছেন।

এদিকে এলপি গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে জ্বালানি কাঠের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাইকার ব্যবসায়ীরা গ্রামাঞ্চল থেকে যত্রতত্র গাছের কাঠ কিনে এনে মজুত করছেন বলে ব্যবসায়ীরা জানান। কাঠের ব্যবহার এভাবে বাড়তে থাকলে পরিবেশের ওপর বড় প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

এ বিষয়ে যশোর সরকারি এম এম কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ছোলজার রহমান বলেন, এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে যদি মানুষ গাছের ডালপালা, লতা-পাতাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে তাহলে অবশ্যই পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। জ্বালানি কাঠের জোগান দিতে গিয়ে সবুজ বনায়ন যদি বিনাশ হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এজন্য জ্বালানি কাঠের জোগান দিতে গিয়ে যত্রতত্র গাছ কেটে ফেলা ঠিক হবে না। পরিবেশ রক্ষায় তাই সরকার ও সব শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতন হতে হবে।