যশোর শিক্ষা বোর্ডে আরও দুই কোটি টাকার চেক জালিয়াতি

প্রতিনিধি, যশোর: মাত্র ১৫ দিনের মাথায় যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে আবার দুই কোটি ৪৩ লাখ সাত হাজার ৮৭৮ টাকার চেক জালিয়াতি ধরা পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি ধরা পড়লে গোপনে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আরও একটি অভিযোগ দেয় শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এখানে বলা হয়েছে হিসাব সহকারী আবদুস সালাম বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন সচিব থাকাবস্থায় এসব জালিয়াতি করেছেন।

এর আগে ৭ অক্টোবর ৯টি চেকে আড়াই কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। প্রথম ঘটনায় দুদক মামলা করেছে। এরপর গত ১১ অক্টোবর আরও একটি চেকে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। বৃহস্পতিবার ধরা পড়ে দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকার জালিয়াতি। এ জালিয়াতি হয়েছে ১৬টি চেকের মাধ্যমে। এ নিয়ে তিন দফায় ২৬টি চেকের মাধ্যমে পাঁচ কোটি ১০ লক্ষাধিক টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে।

শিক্ষা বোর্ডের সচিব বরাবর উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) ও অডিট অফিসার কর্তৃক পাঠানো দুটি লিখিত অভিযোগে এ চেক জালিয়াতির কথা উল্লেখ করা হয়।

শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্র বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ এ চার অর্থবছরে ১১টি চেকে ১০ লাখ ১৫ হাজার ২৬৬ টাকার স্থলে জালিয়াতি করে দুই কোটি ২১ লাখ আট হাজার ৯৪৯ টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আগের চেক জালিয়াতিতে সংশ্লিষ্ট ও জালিয়াতির দায় স্বীকারকারী আব্দুস সালাম হিসাব প্রদান শাখায় বদলি হওয়ার আগে অডিট বিভাগে প্রায় পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে মুড়ি বইয়ের মিলকরণসহ অন্যান্য কাজ করতেন। এ কারণে অডিট অফিসার ও উপপরিচালক সন্দেহের জায়গা থেকে সে সময়ের আর্থিক লেনদেনের দিকগুলো পরীক্ষা করেন।

নিরীক্ষার সময় ১১টি চেকের জালিয়াতি ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি চেকে সালাম নিজের টিএ বিল বাবদ ছয় হাজার ১৯৬ টাকার জায়গায় ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। গত বছর ৪ মার্চ এ ঘটনাটি ঘটে।

১০টি চেক বিজনেস আইটি, নূর এন্টারপ্রাইজ, খাজা প্রিন্টিং প্রেস, নিহার প্রিন্টিং প্রেস, সামিয়া ইলেকট্র্রনিকস, মিম প্রিন্টিং প্রেস, শাহীলাল স্টোরের নামে ও একটি চেক সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামে। সেকশন অফিসারের ৯৪ হাজার ৩১৬ টাকার বিলের স্থলে ৭ অক্টোবর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এছাড়া উপপরিচালকের দপ্তর থেকে সচিবকে দেয়া অন্য অভিযোগে জানানো হয়েছে, বোর্ডের ২০২০-২২ অর্থবছরের ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে চেকের মুড়ি বই যাচাইকালে পাঁচটি চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। ওই পাঁচটি চেকে বিভিন্ন বিল বাবদ চার লাখ ৫৬ হাজার ৭৬৪ টাকা ছিল। জালিয়াতির মাধ্যমে ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৯২৯ টাকা ব্যাংক থেকে ওঠানো হয়েছে। চেকগুলো নূর এন্টারপ্রাইজ, শরিফ প্রিন্টিং প্রেস ও অর্পানেটকে দেয়া হয়েছে।

শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগে ১ ও ২ নম্বর (২০১৭ সালের) ক্রমিকে বর্ণিত চেক দুটি বর্তমান চেয়ারম্যান যখন সচিব ছিলেন সে সময়ের। ক্রমিকের ৩ ও ৪ নম্বর চেক দুটি (২০১৯ সালের) স্বাক্ষরের সময় অধ্যাপক মো. তবিবর রহমান সচিব ছিলেন। এ সময় বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল আলীম। ৫ থেকে ১৬ নম্বর ক্রমিকের চেকে বর্তমান সচিব অধ্যাপক এএমএইচ আলী আর রেজা সচিব ছিলেন। এ সময় দায়িত্ব পালন করেন দুজন চেয়ারম্যান। অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল আলীম ও বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন। বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন ২০২০-এর জানুয়ারি থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি বোর্ডের সচিব ছিলেন। সে সময় তার নামে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে সচিব পদ থেকে তাকে অপসারণ করা হয়। পরে বিভিন্ন মহলে তদবিরের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসতে সক্ষম হন বলে প্রচার রয়েছে। সে সময় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ দুদকে পাঠানো হয়েছিল বলে জানা যায়।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বর্তমানের ১৬টি চেকের দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগটি বোর্ড সচিবের দপ্তরে জমা হলেও প্রকাশ্যে আসতে বিলম্ব হয়। রাত ১১টার দিকে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তথ্যটি প্রকাশিত হয়। ছুটি থাকায় শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে তথ্য জানা দুরূহ হয়। শুক্রবার বিকালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সচিব এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্র মোবাইল ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে অফিস বন্ধ থাকায় তিনি বিস্তারিত জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আগামী কার্যদিবসে ফাইলগুলো দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেয়া হবে বলে তিনি জানান।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গত ৯টি চেকের জালিয়াতি ও দুর্নীতির জন্যে ইতোমধ্যে দুদক যশোর কার্যালয়ে মামলার কার্যক্রম চলমান।

উল্লেখ্য, চলতি মাসে তিন দফায় ২৬টি চেকে পাঁচ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষা বোর্ডের ব্যাংক হিসাব থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব টাকার চেকে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান সচিবের যেমন

স্বাক্ষর রয়েছে, তেমনি চেক প্রস্তুত ও জালিয়াতির সঙ্গে বোর্ড কর্মচারী পলাতক আব্দুস সালামের নাম রয়েছে।

প্রথম দফায় ধরা পড়া ৯টি চেকে জালিয়াতির জন্য বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন, সচিব অধ্যাপক এএমএইচ আলী আর রেজা, হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও শাহীলাল স্টোরের মালিকদের নামে দুদক মামলা করেছে।

এদিকে নতুন আরও দুই কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ার পর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি জানিয়েছেন আরও তদন্ত করার। একই সঙ্গে এসব জালিয়াতিতে জড়িতদের আটক ও চাকরি থেকে অব্যাহতিরও দাবি তাদের। শিক্ষা বোর্ডকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি দিতে তারা সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০