যাতায়াতে পরিবেশবান্ধব বাহনকে গুরুত্ব দেয়া হোক

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: কোনো এক সময় মানুষ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন বাইসাইকেল, রিকশা, ভ্যান, ঠেলা, পালতোলা কিংবা দাঁড়টানা নৌকা। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যন্ত্রচালিত বাহনের মাধ্যমে যাতায়াত শুরু করছেন এবং এই যান্ত্রিক বাহন চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করছে মানুষ। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রার ফলে জলবায়ুর ওপর নীতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে প্রাণ-প্রকৃতির জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। এই বিপর্যয়ের ফলে হুমকির মুখে মানব সভ্যতা। বৈশ্বিক পর্যায়ে আগামীতে মানুষের বেঁচে থাকা না-থাকার বিষয়টি নির্ধারণ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এখানেই শেষ নয়, এই জীবাশ্ম জ্বালানি সংগ্রহ করতে পশ্চিমা আগ্রাসনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সভ্যতা ও জনপথ। নিহত হয়েছে লাখ লাখ নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ।

সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে গেছে নগরকেন্দ্রিক। সে াতের বেগে ছুটে আসছে মানুষ, এর অন্যতম প্রধান কারণ শহর ও নগরে সহজে হাতের কাছেই পাওয়া যায় নাগরিক সুবিধা। শহরগুলোতে নাগরিক সুবিধা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে দূষণও। বিশালসংখ্যক মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ বায়ু। বিশুদ্ধ বায়ু সরবরাহের জন্য নেই পর্যাপ্ত উদ্ভিদ ও গাছপালা।

ঢাকা আয়তনে ছোট হলেও বিশালসংখ্যক মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য বসবাস করেন। এই বিশালসংখ্যক মানুষ যান্ত্রিক বাহন (বিশেষ করে ব্যক্তিগত যান্ত্রিক বাহন) নির্ভর হওয়ার সড়কগুলোয় সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে চলছে। আমরা যদি পরিবেশবান্ধব বাহন ব্যবহার করে যাতায়াত করি, তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমবে। এই জন্য সরকারকে প্রথমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বাসাবাড়ি থেকে ৩-৫ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাজার ও বিনোদনের জন্য উš§ুক্ত স্থান নিশ্চিত করা। তখন মানুষ হেঁটে অথবা রিকশা, সাইকেল ও ভেনে যাতায়াত করতে পারবেন। হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াত করলে শরীরচর্চা এবং ব্যায়ামের জন্য আলাদা সময় লাগবে না।

এছাড়া আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ অসীম নয়। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ কোনো এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমনকি এর আগে সত্তর দশকে ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছিল। এজন্য পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে বিশ্বজুড়েই বাইসাইকেলের কদর বাড়ছে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশের অনেক শহরের উদাহরণও রয়েছে। নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ ও মেক্সিকো সিটির প্রায় সব সড়কে অযান্ত্রিক বাহনের চলাচলের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্যমতে, ইইউর বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৭ সালে ১০৮ কোটি ইউরোর বাইসাইকেল কিনেছে ইইউভুক্ত ২৮ দেশ।

জীব মাত্রই মৃত্যু আছে। কিন্তু সে মৃত্যু যখন স্বাভাবিক হয় না, তখনই আমাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া যান্ত্রিক বাহন নির্ভরতার কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু যে দেশে অপঘাতে মানুষের মৃত্যুর মিছিল লম্বা হতে থাকলেও সরকার এবং আমরা সবাই নির্বিকার।

যদিও জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এই দশকের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনবে বলে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু কীভাবে কাজ করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনবে, তা স্পষ্ট নয়। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাংলাদেশেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে।

দূরপাল্লার যাতায়াত রেলপথের মাধ্যমে এবং শহরগুলোয় ট্রাম বা বাস (গণপরিবহন) বাইসাইকেল, রিকশা, ভেনে যাতায়াত নিশ্চিত করা হলে সড়কে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে। এর সঙ্গে হাঁটার উপযোগী সুন্দর ফুটপাত করা হলে কমবেশি সবাই হেঁটে নিজের কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে পারবে। নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, উন্নত দেশগুলোয় হাঁটাপথ (ফুটপাত), সাইকেল লেন ও গণপরিবহন চলার মূল রাস্তায় তিনটিই সমান গুরুত্ব পায়। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত বাহন সাইকেলের বিষয়টি মাথায় না রেখেই সব সড়ক বানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮ দেশে এবং এশিয়ার দেশ তাইওয়ান ও কম্বোডিয়া বাইসাইকেল রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু নিজ দেশে সাইকেল লেন তৈরি করছে না। পরিকল্পিতভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। তবে সাইকেলের জন্য পৃথক লেন ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে এর ব্যবহার বাড়বে। নতুন যেসব রাস্তা করা হচ্ছে, সেসব রাস্তায় অবশ্যই সাইকেলের জন্য পৃথক লেন রাখতে হবে। যেহেতু রাজধানী ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা তীব্র যানজটোর কারণে ভেঙে পড়েছে, তাই সাইকেলের জন্য আলাদা লেন বাস্তবায়নের মাধ্যমে যাতায়াত ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানোর এখনই সময়।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@mail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০