সাইদুর রহমান, চট্টগ্রাম: ফটিকছড়ির আবদুল্লাহপুর এলাকার প্রবাসী প্রমথ রঞ্জন বড়–য়া (পাসপোর্ট নং-ইই ০৯৫০২০৩)। তিনি সেলাইয়ের (দর্জি) কাজ করেন ওমানের মাসকট শহরে। চলতি বছরের জুলাই মাসে তিনি হঠাৎ কর্মস্থলে স্ট্রোক করেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় স্ট্রোক করার পাঁচ দিনের মাথায় ২০ জুলাই জরুরিভাবে তিনি দেশে ফেরেন। তার ঠিক এক মাস ১০ দিন পর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশ বিমানের একাটি কার্গো ফ্লাইটে প্রমথের পাসপোর্টের বিপরীতে ৩৯৮ কেজির একটি ব্যাগেজ আসে (সি নং-২০৬৪৫)! তবে এ বিষয়ে প্রমথ কিছুই জানেন না এবং ব্যাগেজটির মালিকও তিনি নন!
একই ফ্লাইটে একই এলাকার তাপস বড়–য়াও (পাসপোর্ট নং-ইবি ০৯৮৪৪১৫) ওমান থেকে চট্টগ্রামে আসেন। তারপর ২৪ দিন দেশে ছুটি কাটিয়ে ১৪ আগস্ট মাসকটের এ নির্মাণশ্রমিক ফের ওমানে চলে যান। কিন্তু তার চলে যাওয়ার ঠিক ১৬ দিন পর, অর্থাৎ ৩০ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তাপসেরও ৩৯৯ কেজির একটি ব্যাগেজ আসে (সি নং-২০৬৪৩)! এ বিষয়েও তাপস ও তার পরিবারের কেউই কিছু জানেন না!
অপরদিকে রাউজানের দেওয়ানপুর এলাকার প্রবাসী স্বপন শীল (পাসপোর্ট নং-ইএফ ০৪৬১৪১৩)। তিনিও ১৬ বছর ধরে ওমানের মাসকট এলাকায় রাজমিস্ত্রির (নির্মাণ শ্রমিক) কাজ করেন। গত ৪ আগস্ট ছুটিতে স্বপন দেশে আসেন। তারপর ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ বিমানের ওই কার্গো ফ্লাইটে সারর্জা থেকে স্বপনের পাসপোর্টের বিপরীতেও ৩৮৪ কেজির একটি ব্যাগেজ আসে (সি নং-২০৬৪৬), যেটি সম্পর্কে স্বপন শীল অবগত নন। এছাড়া ২৩ আগস্ট ওমানের মাসকট থেকে চট্টগ্রামে আসেন বাঁশখালীর কদমরসুল এলাকার জাহেদ আকবর (পাসপোর্ট নং-ইজে ০৮০৬৭৩৬)। তার পাসপোর্টের বিপরীতেও বাংলাদেশ বিমানের ওই কার্গো ফ্লাইটে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৮৭ কেজির একটি ব্যাগেজ আসে (সি নং-২০৬৪২)। জাহেদ আকবরের মতো এমন অনেক প্রবাসীর পাসপোর্টের বিপরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাগেজ আসে। কিন্তু এগুলোর বিষয়ে যাত্রীরা কিছুই জানেন না।
মূলত বিদেশ থেকে আসার আগে কার্গোতে ব্যক্তিগত মালামাল বুকিং দিয়ে এলে বাংলাদেশে নেমেই সাত দিনের মধ্যে এয়ারপোর্ট কাস্টমসের কাছে এয়ারওয়ে বিল এবং পাসপোর্টসহ উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত ‘এ-ফরম’ (তফসিল-১ ফরম) পূরণ করে মালামালের ঘোষণা প্রদান করবে যাত্রী। অনুমোদিত ‘এ-ফরম’-এর কপি নিয়ে মালামাল আসার পর প্রযোজ্য শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে এয়ারফ্রেইট ইউনিট থেকে মালামাল নিতে হয়। শুধু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় একজন আগমনী যাত্রী ব্যক্তিগত ব্যবহার্য হিসেবে কতিপয় পণ্য শুল্ক-করাদিমুক্ত হিসেবে আনতে পারেন। এর বাইরে প্রযোজ্য শুল্ক-করাদি পরিশোধ ছাড়া আমদানিকৃত পণ্য চালান খালাস গ্রহণের সুযোগ নেই।
ব্যক্তিগত/বাণিজ্যিক/অনলাইন/কুরিয়ার/ডাক/পার্সেল/কার্গো/কনটেইনার/উপহার Ñ যেভাবেই আমদানি করা হোক না কেন ‘আমদানি নীতি আদেশ’ মেনে আমদানি করতে হবে। ভ্যাট নিবন্ধন/আইআরসি/এলসি প্রভৃতি এর মাধ্যমে আমদানি করতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত প্রায় ৫৩ শতাংশ জরিমানা পরিশোধ করতে হয়। শুধু ব্যক্তিগতভাবে জরুরি বিবেচিত হওয়াসাপেক্ষে স্বল্পতর পরিমাণ পণ্যে ক্যাজুয়াল ভ্যাট নিবন্ধন আবেদনের বিপরীতে জরিমানা মওকুফ করা হতে পারে। মালামাল আসার পর অনুমোদিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে ডকুমেন্টস জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া সরাসরি বিদেশে মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে আমদানির বিষয়ে এসআরও’তে বলা হয়েছে, শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিরা সরাসরি বিদেশ থেকে মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে যে কোনো আমদানিযোগ্য পণ্য মূল্যসীমা নির্বিশেষে বাংলাদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের নামে প্রেরণ করতে পারবেন এবং তাতে প্রাপকের নাম-ঠিকানা আমদানি-সংক্রান্ত দলিলে উল্লেখ করতে হবে। তবে এখানে আমদানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন নেই। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী হিসেবে ওই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে হবে এবং তাতে প্রেরকের পাসপোর্টের নম্বর, পেশা, বার্ষিক আয়, বিদেশে অবস্থানের মেয়াদ ও মূল্য পরিশোধের রসিদে দূতাবাসের প্রত্যয়ন থাকতে হবে।
তবে ওপরের এ চারজন পাসপোর্টধারীর ক্ষেত্রে এমন কিছুই হয়নি। পাসপোর্টধারীরা জানেনই না তাদের নামে বিমানবন্দরে কোনো ব্যাগেজ এসেছে কি না। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইটে আসা ব্যাগেজের অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান করছে শেয়ার বিজ, যাতে বেশ কিছু অনিয়ম ধরা পড়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কার্গোতে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিগত মালামালের ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি, বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি ও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ অর্থ পাচার করা হচ্ছে। আর তাতে জড়িত রয়েছে কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ, ইমিগ্রেশন ও চট্টগ্রাম রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন আমদানিকারক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের পাসপোর্টের ছবি তোলেন খোদ কাস্টমসের কর্মকর্তারাই। তারপর এসব পাসপোর্টের ছবি চলে যায় আমাদানিকার ও সিঅ্যান্ডএফের হাতে। এসব পাসপোর্ট ব্যবহার করে আমদানিকারকরা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ, প্রসাধনীসহ উচ্চ শুল্কের বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে আসেন, যা খালাসে কেজিতে ৬০-৬৫ টাকা সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করা হয়। তবে এসব পণ্যের মধ্যে কিছু চালানে প্রবাসীদের পরিবারের জন্য পাঠানো পার্সেল থাকে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, একসময় এসব পাসপোর্টের কিছু কপি ইমিগ্রশন থেকে এলেও বর্তমানে আসছে কি না, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তবে এ চার পাসপোর্টধারীর সঙ্গে কথা বললে তাদের মধ্যে তিনজন শেয়ার বিজকে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ছাড়া কাউকে পাসপোর্ট দেখায়নি বলে জানান। অর্থাৎ এসব পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন থেকে পাস হতে পারে! তবে অন্য এক এনবিআররের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাসপোর্টগুলো ইমিগ্রেশন থেকে আসে বলে শেয়ার বিজকে নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু তিনিও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
যেসব পাসপোর্টের সঠিক তথ্য ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ যে দেশের প্রবাসী ওই দেশের পার্সেল হলে শুধু সেগুলোতেই প্রবাসীদের পণ্য আসে। আর এক দেশের প্রবাসী অন্য দেশ থেকে পার্সেল আনলে সেগুলোয় জালিয়াতি করা হয়। মূলত এ চালানগুলোয়ই কম শুল্কে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করা হয়, যার বিপরীতে বৃহৎ অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি হয়। এসব আমদানি যেহেতু এলসির মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে হয় না, ফলে পুরো টাকাই হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এছাড়া এ খাতে ব্যবসায়ীদের দেয়া স্পিড মানি (ঘুষ) কাস্টমস বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে আবার ফরেন রেমিট্যান্স হিসেবে গ্রহণ করে বলে জানা যায়।
এ চারটি চালানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ চার প্রবাসী ওমানের হলেও তাদের পণ্য এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এছাড়া চারটি চালনের আমদানিকারক, অর্থাৎ চার পাসপোর্টধারী ভিন্ন ব্যক্তি হলেও আমদানিকারকের ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে একটি (এটি মূলত সিঅ্যান্ডএফের নম্বর)। যদিও এই চার ব্যক্তির কেউ কাউকে চেনেন না। অর্থাৎ চালানে কোনো প্রকার বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ার জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এই কূটকৌশল অবলম্বন করেছেন।
জানা যায়, চালানগুলো খালাসে কাজ করেছে চট্টগ্রাম স্ট্যান্ডার্ড রোড বন্দর এলাকার আইএমএস মমতাজ টাওয়ারের ট্রাস্টেড ক্লিয়ারিং লিমিটেড। এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রপ্তানিকারক হিসেবে কাজ করেছে (কার্গো বুকিং নিয়েছে ) আল নাস এক্সপ্রেস কার্গো এলএলসি নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে বুকিংকারী সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। অর্থাৎ চালানগুলো খালাসে দেশ ও বিদেশে একই সিন্ডিকেটের লোক কাজ করছেন।
ফটিকছড়ির প্রবাসী প্রমত রঞ্জন বড়–য়া, ১৪ আগস্ট ওমানে ফেরত যাওয়া তাপস বড়–য়ার স্ত্রী সুমুতা বড়–য়া ও রাউজানের স্বপন শীল তাদের পাসপোর্টের বিপরীতে এসব ব্যাগেজ আসার সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না বলে শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন। প্রমত বলেন, আমি এসেছি ওমান থেকে। আমার ব্যাগেজ কীভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসে? আরব আমিরাতে তো আমি থাকি না, সেখানে আমার কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ও নেই। তাহলে এই ব্যাগেজ কে আনল বা পাঠাল। ঠিক এ কথা বলেন রাউজানের স্বপন শীলও। আর তাপস বড়–য়ার স্ত্রী সুমুতা বড়–য়া বলেন, আমার স্বামী তো ১৪ আগস্ট বিদেশে চলে গেছেন, ৩০ আগস্ট তার পাসপোর্টের বিপরীতে আরব আমিরাত থেকে ব্যাগেজ কীভাবে আসে? শেষে বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওমানে থাকা তাপস বড়–য়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এমন কোনো ব্যাগেজ পাঠাননি বলে জানান এবং ইমিগ্রেশন ছাড়া অন্য কাউকে পাসপোর্ট দেখাননি বলেও নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট কাস্টমসের সহকারী কমিশনার জয়নাল আবেদিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমদানিকারকদের পক্ষে ছাপাই গেয়ে বলেন, এক দেশের যাত্রীর অন্য দেশ থেকে ব্যাগেজ আসতে পারে! ট্রানজিটের কারণে এমন হয়! তবে তাকে ট্রানজিটের কারণে ‘কান্ট্রি অব অরেজিন’ (রপ্তানিকারক দেশ) কি পরিবর্তন হয়? যাত্রীর এ-ফরম কারা পূরণ করে এবং পণ্য খালাসে ইমিগ্রেশনের সঙ্গে পাসপোর্ট মেলানো হয় কি নাÑএমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে জানতে ট্রাস্টেড ক্লিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম জহিরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া যায়নি। তবে ট্রাস্টেড ক্লিয়ারিং লিমিটেডের এয়ারফ্রেইট ইউনিটের দায়িত্বে থাকা জহিরুল ইসলামের ভাই মো. হাসান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে প্রবাসীদের ব্যাগেজের মাধ্যমে কোনো অবৈধ পণ্য আসে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে প্রবাসীদের সার্ভিস দিয়ে আসছি। কোনো ধরনের অবৈধ পণ্য আমদানি হয়েছে এমন নজির নেই। ফলে দেশের অন্যান্য বিমানবন্দর দিয়ে এয়ারফ্রেইট বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রামে চালু রয়েছে। তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম বিভাগে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক লাখ প্রবাসী রয়েছেন, যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। তারাই মূলত বৈধ কাগজপত্র না থাকায় অন্যের ডকুমেন্ট ব্যবহার করে পরিবারের জন্য পণ্য পাঠান। এছাড়া এক পাসপোর্ট ব্যবহার করে প্রায় ৪০০ কেজির ব্যাগেজ এলেও ভেতরে ২০-২৫ প্রবাসীর ছোট ছোট পার্সেল থাকে। আপনারা একটি ব্যাগেজের প্যাকিং লিস্ট দেখলেই জানতে পারবেন। কোন প্রকার বাণিজ্যিক বা অবৈধ পণ্য আসে না বলে নিশ্চিত করছি।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাজিউর রহমানের অধীনে রয়েছে এ শাখা। এ বিষয়ে তার থেকে জানাতে চাইলে তিনি বিষয়টি ভয়াবহ বলে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান। একই বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দার চট্টগ্রাম অফিসের যুগ্ম পরিচালক সাইফুর রহমানও অনুসন্ধান করবেন বলে জানিয়েছেন।