নিজস্ব প্রতিবেদক: সড়ক নিরাপদ করতে সরকার আইন ও বিধিমালা করেছে। কিন্তু সড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক নির্দেশনা জারির কথা থাকলেও তা হয়নি। গতি নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে সড়কে মৃত্যু কমবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের গ্রামীণ-আঞ্চলিক ও জেলার সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের প্রকারভেদ ও উপযোগিতা বুঝে গতি নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা হচ্ছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) উদ্যোগে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। ‘সড়ক ও যানবাহনের প্রকারভেদে গতি নির্ধারণ, ব্যবস্থাপনা, মনিটরিং এবং বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে অংশ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, সড়কে গতি নির্ধারণে নীতিমালা হচ্ছে। গতি কম থাকলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। নীতিমালা প্রণয়নে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেয়া হবে।
ঢাকা মহানগরীতে মোটরসাইকেলের গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার করার কথা ভাবা হয়েছিল, কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, সব মহানগরে যানবাহনের গতি ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটারে থাকে। কিন্তু মানুষ সেটা মানতে চায়নি, গতি আরও বেশি চায়।
সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর তথ্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সচিব বলেন, বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) প্রতিদিন দুপুর ১২টায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে। সবাইকে এটি অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে কোনো তথ্য যদি ভুল মনে হয়, তবে সেটাও যেন জানানো হয়।
সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ানোরও আহ্বান জানান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। নিরাপদ সড়কব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তিনি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। এ ছাড়া বলেন, সবাইকেই সড়কের আইন জানতে ও মানতে হবে।
গোলটেবিলের মূল প্রতিপাদ্য তুলে ধরেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এসএম সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ অতিরিক্ত গতি। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ও রাস্তার জন্য একটি নিরাপদ গতিসীমা নির্ধারণ এবং এর তদারকিতে মনোযোগী হতে হবে।
সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, দেশের বাইরে গেলে মানুষ আইন মানে, কিন্তু দেশে সে মানুষই আইন মানে না। কারণ সে জানে, এখানে আইন ভঙ্গ করলে কিছু হবে না। এ জায়গায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
এখনও টোল ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় করা যায়নি বলে উল্লেখ করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, টোল দিতে গিয়ে যানজট হচ্ছে। সড়কে ডিজিটাল সাইনবোর্ড লাগানোরও আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে সড়ক আইনের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের জানানোর আহ্বান জানান।
সড়কে আইনের প্রয়োগ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি শ্যামল কুমার মুখার্জী বলেন, প্রতিদিন মহাসড়কে তিন হাজার মামলা হচ্ছে। দেশের বাইরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেখানে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পান পথচারী ও সাইকেল আরোহীরা। সবচেয়ে কম প্রাধান্য পায় বড় ও ভারী যান। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক উল্টোটা হয়। সড়ক নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও আইন কার্যকর হলে মূল্যবান জীবন বাঁচবে।
সাধারণ মানুষকে সড়কের সাইন (চিহ্ন) ও নীতিগুলো অবগত করার ওপর গুরুত্ব দেন ব্র্যাকের প্রশাসন ও সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসাইন। যানবাহনের গতির বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নে দেশীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়ার কথাও বলেন তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার সোহেল রানা বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণের পেছনে পুলিশের অনেক সময় চলে যায়। ফলে অন্যান্য বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো দুরূহ হয়ে পড়ে। গতি নির্ধারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।
নাট্যব্যক্তিত্ব ম হামিদ নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, বাসগুলোয় নম্বরপ্লেট সঠিক জায়গায় থাকে না এবং অনেক সময় তা অস্পষ্ট থাকে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে বলে জানিয়ে এ বিশিষ্টজন বলেন, সড়কে পথচারী হিসেবে চলতে গেলে তিনি সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করেন।
গোলটেবিল অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আমজাদ হোসেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তানভীর সিদ্দিকী, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সিনিয়র রোড সেফটি স্পেশালিস্ট মো. মামুনুর রহমান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম, নিসচার মহাসচিব লিটন এরশাদ প্রমুখ।