নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈশ্বিক মন্দাভাব বিশেষত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বিদায়ী অর্থবছর দেশের অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই মন্দা গেছে। ডলার সংকট, এলসি খুলতে না পারা, সরকারের কৃচ্ছ সাধন নীতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিÑসব মিলিয়ে রপ্তানি খাতও পড়ে সংকটে। অর্থবছরের শুরুর কয়েক মাস রপ্তানিতে রেকর্ড নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা যায়। তবে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে মোটামুটি ঘুরে দাঁড়ায় রপ্তানি খাত। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছর রপ্তানি আয়ে ছয় দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
যদিও গত অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানি আয়ে। এর মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য প্রধান পণ্যগুলোর রপ্তানি থেকে আয় কম হওয়া। এছাড়া প্রধান দুই বাজারে (যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি) রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। শীর্ষ অন্যান্য গন্তব্যের মাঝে পোল্যান্ড, চীন ও রাশিয়ায় বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে। এর মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি কমার হার সবচেয়ে বেশি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছর শীর্ষ ১৬টি দেশের মধ্যে পাঁচটিতে রপ্তানি আয় কমেছে।
তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। প্রতিবারের মতো গত অর্থবছরও দেশটিতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তবে গত অর্থবছর রপ্তানি আয় কমেছে দেশটিতে। ইপিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের, যা মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে আগের (২০২১-২২) অর্থবছর একই সময় থেকে ছয় দশমিক ৮৮ শতাংশ কম পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ওই অর্থবছর পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার ও হোম টেইক্সটাইল। এ তিন পণ্যেরই রপ্তানি আয় কমেছে গত অর্থবছর। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে পাঁচ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারের ওভেন, দুই দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার নিটওয়্যার এবং হোম টেক্সটাইল ১৭ কোটি ডলার। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর প্রধান তিন পণ্য দেশটিতে রপ্তানি হয়েছিল যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন, তিন দশমিক ১২ বিলিয়ন ও ৩১ কোটি ডলার।
গত অর্থবছর জার্মানিতে পণ্য রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশটিতে সাত দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছর ছিল সাত দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় নিটওয়্যার, ওভেন পোশাক ও হোম টেক্সটাইল। গত অর্থবছর এ তিন পণ্য যথাক্রমে চার দশমিক ১২ বিলিয়ন, দুই দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ও ১০ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছর এ তিন পণ্য রপ্তানি আয় ছিল যথাক্রমে চার দশমিক ১৮ বিলিয়ন, দুই দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ও ১১ দশমিক ২৯ কোটি ডলার।
বিদায়ী অর্থবছর পোল্যান্ডেও বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমেছে। দেশটিতে গত অর্থবছর পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের। তার আগের (২০২১-২২) অর্থবছর হয়েছিল দুই দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর দেশটিতে সবচেয়ে বেশি এক দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের নিটওয়্যার, ৬৩ কোটি ডলারের ওভেন গার্মেন্টস ও ৩ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ তিন খাতেই রপ্তানি কমেছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যের মধ্যে চীন রয়েছে ১১তম স্থানে। বিদায়ী অর্থবছরে চীনে ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা তার আগের (২০২১-২২) অর্থবছর ছিল ৬৮ কোটি ডলার। ফলে গত অর্থবছর চীনে পণ্য রপ্তানি আয় কমেছে ০.৮৯ শতাংশ। দেশটিতে ওভেন, নিট ও হোম টেক্সটাইল সামান্য কিছু রপ্তানি হয়। এগুলো গত অর্থবছর রপ্তানি বেড়েছে। তবে কমেছে মূলত চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক দ্রব্যাদির।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের দিক থেকে ১৬তম অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। এ দেশটিতেও বিদায়ী অর্থবছর রপ্তানি আয় কমেছে। তবে শীর্ষ ১৬টি দেশের মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশটিতে ৪৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, যা তার আগের (২০২১-২২) অর্থবছর হয়েছিল ৬৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছর দেশটিতে পণ্য রপ্তানি কমেছে ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাশিয়ায় সামান্য রপ্তানি হলেও তৈরি পোশাক বিশেষত ওভেন, নিট ও হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে।
বিদায়ী অর্থবছর পাঁচটি দেশে পণ্য রপ্তানি কমলেও বাকি দেশগুলোয় রপ্তানি আয় বেড়েছে। গত অর্থবছর সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ইতালিতে। দেশটিতে বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে দুই দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এরপর রয়েছে জাপান। দেশটিতে বিদায়ী অর্থবছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর জাপানে রপ্তানি হয় এক দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক দশমিক ৯০ ডলার।
এছাড়া গত অর্থবছর অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ, স্পেনে ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, কানাডা ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, তুরস্কে আট দশমিক ২২ শতাংশ, ভারতে ছয় দশমিক ৯৩ শতাংশ ও বেলজিয়ামে চার দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এদিকে বিদায়ী অর্থবছর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও ওভেনে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি আয় কমেছে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, চামড়া-চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা এক দশমিক ৭৩, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ ২৬ দশমিক ২৬, কৃষিজাত পণ্য ২৭ দশমিক ৪৭, ফার্মাসিউটিক্যালস সাত দশমিক ০৭, কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য ১৯ দশমিক ১০, বাইসাইকেল ১৫ দশমিক ৩১ এবং প্রকৌশল দ্রব্যাদি ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে। যদিও এ সময় প্লাস্টিক/মেলামাইন দ্রব্যাদির রপ্তানি আয় ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে।